Monday, October 23, 2023

অথ ফার্স্টক্লাসকথা (22/10/23)

অথ ফার্স্টক্লাসকথা


 আমার বন্ধু সপরিবারে রাজস্থান ভ্রমণে যাচ্ছেন আপাতত একটি ইচ্ছাপূরণের আনন্দ নিয়ে। ভ্রমণ শেষে ফিরবেন ডবল ইচ্ছাপূরণের তুরীয়ানন্দে ভরপুর হয়ে। ২য় ইচ্ছাপূরণ তো রাজস্থান ভ্রমণ। আর ১মটি হল রেলের ফার্স্টক্লাস এসিতে ভ্রমণ। তাঁর এই বার্তাই আমার অনেক স্মৃতিকে উসকে দিল আর আমিও কিছু কথা উগরে দিলাম।


আমাদের ছোটোবেলায় রেলে এসির আবির্ভাব কি হয়েছিল? ফাস্টোকেলাশ ছিল। একবার সেই ফাস্টোকেলাশে বাঁকুড়া গিয়েছিলাম। পিসতুতো দাদার সঙ্গে দাদার শ্বশুরবাড়িতে। সেই দাদা তখন রেলের উঁচু কেলাশের টিটিই। সেদিন  ওবিশ্যি দাদার রথ দেখা কলাবেচা দুইই ছিল, নাকি শুধুই বৌ দেখা ছিল তা আর আজ মনে নেই। অন-ডিউটি দাদার সঙ্গে একবার পুরী গেছিলাম - রথ দেখা-কলাবেচা সিস্টেমে। তবে সেবার কোন কেলাশে তা মনে নেই। সে সব সুদূর শৈশব! তার পর প্রথম এরোপ্লেন চড়া! ইস্কুল থেকে ১৫আগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি, মনে নেই সঠিক। শুধু মনে আছে অনেক গর্জনসহ যখন আকাশে উড়লাম তখন গতিবেগের অংক গুলিয়ে ফেলে নিচের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে ভেবেছি এটা কি তাজমহল! সে ছিল ১৫ মিনিটের অভিজ্ঞতা! তারপর দেখলাম আস্তে আস্তে রেলের জানলা সিল হল শীত ও আতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য। তখন আমরা পাবলিক প্লেসে শুধু ট্র্যাফিক নয় তেজ ও মরুৎ এই দুই ভূতকেও কন্ট্রোল করা শুরু করলাম। এর সঙ্গেই শুরু  হল শ্রেণীবিভেদের যুগ - দুনম্বর এসি, তিননম্বর এসি, এসি চেয়ারকার আর ফাস্টোকেলাশ এসি। আমার আওতায় তখন চেয়ারকার আর তিননম্বর। তবে স্টেশনে কেউ যদি টা টা করতে আসত তখন আমার খুব দুঃখ হত জানলা খুলে গল্প করা আর চাকা গড়াতে শুরু করলে শেষবার হাত মেলানো যায় না বলে। তাছাড়া সারা পথ জুড়েই জানলার রডের ফাঁক দিয়ে চায়ের ভাঁড়, কলার ছড়া, ছোলা-পিঁয়াজ বা লুচি-আলুর তরকারির শালপাতার ঠোঙা গ্রহণ-বর্জনেও নিষেধাজ্ঞা জারি হল। এর আগের যুগে স্টেশনে নামা সহযাত্রীর দিকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিলে সেটাও ঐ চ্যানেলে যাতায়াত করেই ভরে উঠত। হ্যাঁ, তখনও দ্বিতীয় ভূত অপ আমাদের হাতে বোতলবন্দী হয়নি। এর পরের যুগ ওড়ার যুগ।  যখন মহীশূরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অভ ইন্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজেসের আমন্ত্রণে ওঁদের আয়োজিত উইন্টার স্কুলে  টিউটরিং করতে যাচ্ছি ওঁরা বললেন উড়ে আসতে। সে কি আনন্দ! তখনও কিন্তু  চাকুরিক্ষেত্রে পদমর্যাদা অনুযায়ী আমার যত্রতত্র ওড়া ধার্য হয়নি। ওই উইন্টার স্কুল ছিল আন্তর্জাতিক স্তরের, দেশ-বিদেশ থেকে বহু বিদ্বান বিশেষজ্ঞেরা উড়ে আসবেন। সেখানে আমি দুদিন ধরে রেলে চড়ে বিধ্বস্ত হয়ে এসে হাজির হব, সেটাতে হয়ত তাঁদের সম্মানহানি হত, তাই আমাকে উড়তে বলা! তা সে যে কারণেই হোক উড়ে যাওয়ার কথা শুনেই আমি তো মনে মনে উড়ছিই। এরপর হাতে এল ওড়ার টিকিট - উঁহু, এখনকার মতো দৃশ্য-স্পর্শ-গন্ধহীন নয় মোটেই। ব্যাংকের চেকবইয়ের মতো বাঁধানো চার পাতার চকচকে ঝকঝকে টিকিট - কভার পেজে স্বাগত-ভঙ্গিমায় এয়ার ইন্ডিয়ার জমকালো মহারাজা! বাগে পেয়েই মহারাজাকে চকাস চকাস করে কটা চুমু খেয়ে নিলাম। এদিকে তো তখন হরিণাম চলছে পড়াশুনো নিয়ে। এরপরে অনেকবারই মহীশূর গেছি, প্রতিবারই উড়ানে, কারণ ততদিনে আমি উড়ানানুমতি মাফিক পদমর্যাদা অর্জন করেছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো এমন থ্রিলিং আর কখনও লাগেনি। আর এরপর তো উড়ান-ব্যবসায়ে যুগান্তকারী বিবর্তন এসে উড়ান ব্যাপারটাই বহু মানুষের পকেটের নাগালে চলে এল! এখন তো প্রায়শই দেখা যায় রেলের ফাস্টোকেলাশ  এরোপ্লেনের চেয়েও দামি! তার ওপর রেল আবার খাবার-দাবারের ছুতমার্গে বিচরণ করে। ফলে এত নিরামিষ ভ্রমণ, হজম হওয়া কঠিন! রেলভ্রমণের যুগবিভাগে কাঁচের সিল করা জানলা যদি আধুনিক যুগ হয় তো নিরামিষ ফাস্টোকেলাশকে অনায়াসে উত্তর-আধুনিক আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। 

এ পর্যন্ত অনেক ছড়ালাম। এবার একটু গোটাতে চেষ্টিত হই। ২০১৮ সাল, বেড়াতে গেছি শ্রীলংকা। ২০১৮ মানে পৃথিবীতে তখন কোভিড-পূর্ব যুগ চলছে এবং ভারতীয় রেলের আধুনিক যুগ। আমরা তিনমূর্তি - আমার ইস্কুলের পায়ে-চাকা বন্ধু মধুমিতা, আমার ছোটো বোন যার পায়ে চাকা থাকলেও তার চাকুরির সৌজন্যে হুট বলতে তা পাংচার হয় সেই কাজল আর আমি। আমাদের তিনজনেরই দৃঢ় ধারণা যে মোটামুটি সারা পৃথিবী জুড়ে না হোক অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় এখন রেলের আধুনিক যুগ চলছে এবং সেটা ভারতীয় রেলের মডেলেই। আমরা ফিরব শ্রীলংকার দক্ষিণের শহর মাতারা, তারাপীঠের ব্রাঞ্চ নয় কিন্তু, থেকে কলম্বোয়, রেলে চড়ে। টিকিট করতে গিয়ে দেখলাম ফাস্টোকেলাশ আর ২য় শ্রেণী আছে। ফাস্টোকেলাশের টিকিটও রয়েছে। দামের তফাৎ অনেকটা থাকলেও আমাদের সাধ্যের মধ্যেই ফাস্টোকেলাশ। তাছাড়া ওটাই আমাদের ভ্রমণের অবশিষ্টাংশ, এর পর ঘরে ফেরা, হাতে যা টাকাকড়ি আছে তাতে শখটা মেটানোই যায়। অতএব কালবিলম্ব না করে ফাস্টোর টিকিট বুকিং করা হল। ট্রেন যাবে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। তেমন গরমের দিন না হলেও হিউমিডিটি যথেষ্ট বেশি। ফাস্টোতে আরামে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কলম্বো পৌঁছে যাব। নির্দিষ্ট দিনে মালপত্তর ও অশেষ উত্তেজনা নিয়ে ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। জিগেস করে জেনে নিয়েছি প্ল্যাটফর্মের কোথায় অবস্থান করবে ফাস্টো। তবে শান্তিনিকেতন-কলকাতা যাতায়াতের পথে এসি চেয়ারকারের যে চাহিদা আর ভীড় দেখেছি তার কিছুই এখানে নেই। এবার ট্রেনে ওঠার পালা। ফাস্টোকেলাশ হল ট্রেনের একদম সামনে, ইঞ্জিনের পরেই। দূর থেকে কামরার গা দেখে আলাদা করে চেনা যায় না তার ফাসটোত্ব। উঠলাম। পুরো ট্রেন জোড়া ২য় শ্রেণী দেখতে দেখতে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়েছি - গদি আঁটা লম্বা লম্বা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সিট, সব কামরাই প্রায় ফাঁকা। ফাসটোতে চেয়ারকারের মতো দুদিকে ভাগ করা ছোটো ছোটো সিট। দেওয়ালে ছোটো ছোটো দেওয়াল পাখা। জানলা সিল করা নয়। এসি???? না, শ্রীলংকার রেলে এখনও আধুনিক যুগ আসে নাই! তাহলে ফাসটোর বিশেষত্বটা কি? টয়লেট আছে। সে তো সব কামরাতেই আছে। আর আছে কামরার শেষভাগে একটা বেশ বড়োসড়ো লাগেজরুম। সেখানে ব্যাগপত্তর রেখে যাত্রীরা ঝাড়াহাতপা হয়ে নিজের সিটে পাখার হাওয়া খেতে খেতে কোস্টাল সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভ্রমণ করবেন। কয়েকটা জানলায় অক্ষত পর্দা আছে, বাকিরা বঞ্চনার শিকার। যাদের পর্দা আছে তাদের আবার পর্দার তার ঢিলে, ফলে পুরো পর্দাটি জড়ো হয়ে মাঝখানে ঝুল্যমান। কয়েকটি পাখা চালু, বাকিরা অচল অনড়। এখন দুপুরের মার্তণ্ড মাথার ওপরে। পরে তিনি পশ্চিমমুখী হবেন। তখন বাঁদিকের জানলা দিয়ে উপকূলীয় সৌন্দর্যের সঙ্গে রোদ ফ্রি। ডানদিকের সারিতে সমুদ্র না থাকলেও ফ্রি কিন্তু ফ্রিলি তার স্পর্শ বুলিয়ে যাবে। আমরা তিনমূর্তি ছাড়া আর জন চারেক যাত্রী, তারাও বিদেশি, তারা বিতর্কবিহীনভাবে হয় সাদা নয় কালো, আমাদের মতো দুরঙের মিশেলে 'যে জন আছে মাঝখানে ' মার্কা নয়। তবে বাইরের রঙে যতই তফাৎ থাক মগজে যে সবাই এক গোত্রীয় তা বলাই বাহুল্য! এই হল রাবণীয় ফাস্টোকেলাশ! অসীম হতাশা নিয়ে লটবহর আশপাশেই গুছিয়ে নিয়ে জানলার পর্দা হাত দিয়ে টেনে রোদ্দুর আড়াল করে সিটে থিতু হলাম। কামরা এতটাই ফাঁকা যে পেছনের অদৃশ্যমান লাগেজরুমে জিনিসপত্র রাখাটা সমীচীন বোধ হল না। ট্রেন ছাড়লো। খানিক পরে বোঝা গেল ইঞ্জিনটি কয়লার। ফাস্টোকে সীমাহীন ধোঁয়া ও কয়লার গুঁড়ো উপহার দিতে সে না চাইতেই কল্পতরু। তার সঙ্গে আছে মাঝেমাঝে ঘটঘটঘটঘট করে পিলে চমকানো শব্দ। ইঞ্জিন যেন বিদেশী অতিথিদের দুহাতে কালো হীরের দ্রব্যগুণ উপহার দিতে দিতে অট্টহাস্য করতে করতে চলেছে! 

সব জিনিসেরই ভালোমন্দ আছে। শুধু একদিকের আখ্যান শোনালে তো সবাই একচোখো বলবে। কিন্তু আমার তো দুটোর জায়গায় চারটে চোখ। তাই একটু অন্যদিকে দেখি।

দুপুর থেকে বিকেল অবধি অনেক ঘাম ঝরিয়ে, হাঁসফাঁস করে, নানা বিভঙ্গে রোদ এড়িয়ে, কয়লা-কজ্জলিত চোখ রগড়ে শেষ অবধি বিকেলের মরা রোদে যে সূর্যাস্তটি সেটা কিন্তু সত্যিই ফাস্টোকেলাশ!  রঙ ছড়িয়ে আকাশ আর সমুদ্দুরকে একাকার করে শ্রীলংকার সুয্যিদেব এক পা এক পা করে পাটে নামতে নামতে টুপ করে ডুব দিলেন। কি অপূর্ব কি অপূর্ব! এই পাওয়াটা সব কষ্ট পুষিয়ে দেয়। যদিও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকেও একই দৃশ্য একই ভাবে দেখা যেত! 


ফাস্টোকেলাসের ধরনধারন দেখে কাজল খানিকটা শোকে-তাপে মুহ্যমান ছিল। আর মধু কয়েকবারই বলেছিল - চল, পেছনের কোনো কামরায় চলে যাই। আমি একটুও রাজি হইনি। প্রেস্টিজ কা সওয়াল বলে কথা! ফাস্টোর টিকিটে সেকেন্ডে চড়েছি - দেশে ফিরে এই গল্প করলে লোকে হয়তো ভাববে নামিয়ে দিয়েছে! তার চেয়ে একটু কষ্ট করে ফাসটোতেই শেষ অবধি  টিঁকে থাকতে পারলে ফিরে তো কলার তুলে বলতে পারব! তবে কলার তোলাটা আগেই হয়ে গেছে, বলে ফেলাটা আজ সারলাম। এটা কনফিডেনশিয়াল - পাঁচকান না হলেই ভালো!

Sunday, October 22, 2023

আমার পঞ্চমীযাপন (2023)

আমার পঞ্চমীযাপন


এদিকে সবাই সারারাত ধরে সম্বচ্ছরের মর্নিং ওয়াকে নেমে পড়েছে। আমিই বা পিছিয়ে পড়ি কেন? একে আনন্দবাজার পড়ি না। দুইয়ে কোনো পিছিয়ে পড়ার কম্পিটিশনও হচ্ছে না। তিনে ভীড়ে গা মাসাজ করি না। এই তিন যেন ত্রিনয়নে চোখ মেরে দুয়ো দিচ্ছে! কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! তাই সকাল পৌনে ছটা নাগাদ বাজারে যাবার পার্সটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বিকে পাল অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একটা বাস চাই, হাওড়ার বাস। আশপাশে দেখছি কত স্কুটি চড়া দম্পতি, বন্ধু জোড়ায় জোড়ায় এসে মণ্ডপে ঢুকছে। এরা পুরোনো জামায়, আমার  মতো। অটো দাঁড় করিয়ে  হাঁটু খারাপ মা ও  ঢকঢকে বাবাকে নিয়ে মেয়ে নামছে - এরাও পুরোনো জামায়। জন চারেক এল সাইকেলে - দেখে মনে হল মিস্ত্রি বা সাফাইকর্মী। আমরা তো পোশাকেই বিচার করি। তবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যারা নামছে তারা, বিশেষ করে তরুণীরা, একেবারে র্্যাম্পের ঝলমলানি, শুধু সারা রাতের ক্লান্তিতে একটু ম্লান। একটু দাঁড়াতে হল। একটা জানলার ধারে সিটওলা মিনিবাস পেলাম। গিয়ে নামলাম হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের গা ঘেঁসে। এবার ব্রিজের দিকে হাঁটা। রাস্তা পার হতে হলে কিন্তু খুব জটিল ট্রাফিক!

শুনেছি, ছবিও দেখেছি হাওড়া ব্রিজে আল্পনা দেওয়া হয়েছে। এটা রথ দেখা। আর আজ অবধি কোনোদিন কলকাতার সিগনেচার হাওড়া ব্রিজ হেঁটে পার হইনি - এটা কলা বেচা! রাস্তা পারের জটিলতা যতদূর সম্ভব কম ঘাড়ে নিয়ে পৌঁছলাম ব্রিজের ডানদিকের মানে স্টেশনের দিকের ফুটপাতে। কি চওড়া ফুটপাত! দুদিকে রেলিং - ডানদিকে নদী, বাঁয়ে রাক্ষুসে ট্রাফিক! মাঝখানটা কিন্তু দারুণ থ্রিলিং। দেখলাম আরও কয়েকজন এমনই ছিটেল - ছবি তুলতে এসেছে ব্রিজে। আমিও কটা ছবি তুললাম। পথের দুধারে লম্বা করে আল্পনা, কদিনে কিছুটা মলিন। ছবিতে একটা বড়ো গোল সেন্টার পিসও দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা খুঁজে পেলাম না। চাকায় চাকায় উঠে গেছে? কে জানে। কলকাতার দিকে শেষ প্রান্তে জগন্নাথ ঘাটের সিঁড়ি পেরিয়ে দেখি বাঁদিকের রেলিং আরও শক্তপোক্ত, কোনো কাটা নেই। অথচ আমি তো দক্ষিণ কলকাতায় যাব না, রাস্তা পেরোনো জরুরি। ফুলওলাদের জিগেস করতে বলল আবার ব্রিজের শুরুতে ফিরে গেলে পেরোতে পারব, নয়তো রেলিং টপকে! সামনে কোনো কাটা নেই!! রেলিং ধরে খানিক দাঁড়ালাম - পাশে একজন পুং সদ্য পেরিয়ে বস্তাটা রেলিংএ রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তার পেছনে আরও একটি পুং রেলিংএ চড়ে বসে আছে বস্তা সমেত। আমার সামনে একজোড়া মা-মেয়ে ওপার থেকে ছুটে রাস্তা পেরিয়ে এল। ওদের বস্তা নেই। ভাবলাম ওরা রেলিং পেরিয়ে ফুটপাতে উঠবে। নাঃ, বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম বস্তাই হল রেলিং টপকানোর পাসপোর্ট। আমার পাসপোর্ট নেই! তবে আপাতত আমার আশেপাশে এরা আমাকে একটা ক্ষণস্থায়ী কভার দিচ্ছে এবং সামনে কোনো পুলিশ দেখছি না। অতএব দুগ্গা দুগ্গা বলে রেলিংএ উঠে পড়লাম। রেলিংএর উচ্চতা আমার চিবুক অবধি। চড়লাম, সামিট করে ওপাশে নেমে নিরীহতম মুখ করে মা-মেয়ের পাশে দাঁড়ালাম। এবার রাস্তা পার হওয়া। পাঁচটা রাস্তা পরপর বিছোনো। ! ৩+২ হিসেবে পেরোতে হবে। মাঝে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই, দাঁড়ালেই একেবারে ক্রিকেটের বলের মতো ছক্কা হাঁকিয়ে দেবে! ফ্লাইওভারের মুখটায়। একটায় গাড়ি বন্ধ হয় তো অন্যটায় চালু হয়। অদেখা সিগন্যালবৃন্দের শেষ ও শুরুর মাঝে যাহোক করে অক্ষত অবস্থায় পার হলাম। খানিক পরে সোবাবাজার সোবাবাজার হাঁকতে হাঁকতে যে মিনিটা এল তার গায়ে বিকে পাল লেখা দেখে উঠে পড়লাম। ওমা! একটু পরেই সেটা (নিমতলা) শ্মশান মুখী না হয়ে গণেশটকির দিকে ঘুরলো! 

- এটা বি কে পাল যাবে না?

- না, আমি কি বিকে পাল বলে হেঁকেছি?

- বাসের গায়ে যে লেখা রয়েছে?

- ক'বছর হয়ে গেল ঐ রাস্তায় যায় না।

- আমিও এই পথে রোজ যাই না।

- এটা সোবাবাজার যাবে।

- শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন - তাই তো?

- হ্যাঁ।

- স্টেশন তো বলেননি!

- স্টেশন বলতে হবে?? ওটা কি সোবাবাজার নয়?

- না, নয়। আমায় নাবিয়ে দিন। 

মালাপাড়ার মুখে নেবে ভাবলাম আমার এক দিদিমা তো হাওড়ায় ট্রেন থেকে নেবে হেঁটেই আমাদের বাড়ি আসতেন। ছোটোবেলায় গ্রামের আরও আত্মীয়দের হাওড়া থেকে হেঁটে আসতে শুনেছি। আমিও না হয় হাঁটি আজ। তারপর গুটি গুটি পায়ে এগোতে শুরু করলাম। পথে দুবার থেমেছি । পাথুরেঘাটা থেকে জোড়াবাগানের মোড় অবধি খৈনিবংশীয়  রাজত্ব। প্রায় ৯০% দোকানেই লম্বা লম্বা তামাক পাতা হাত মেশিনে কুঁচিয়ে বিক্রি হয়। আর এই সব ডিটেলস জানতে আমার ৬৫ বছর লেগে গেল! এই অঞ্চলে এক মহিলা একটি বন্ধ দোকানের সামনের পাথরে বসে মাথা আঁচড়াচ্ছিলেন। পাশে জায়গা ছিল। সেই  বনলতা খৈনির পাশে কিছুক্ষণ বসেছি। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে দুমুখ হেসেছি। আসবার সময় তাঁকে বলেও এসেছি। আর একবার- আহিরীটোলা প্যান্ডেলের কাছাকাছি বিকে পাল অ্যাভিনিউয়ের মাঝমধ্যিখানে এক জটিল-মস্তিষ্ক দুর্গা কোনো অদৃশ্য অসুরের উদ্দেশে অভিধান বহির্ভূত শব্দসহ প্রচুর চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছিল। হাতে একটি হ্যান্ডলবিহীন হাতপাখা।  ইচ্ছে করলেই যানজটরূপেণ সংস্থিতা হয়ে যেতে পারে। তা আমি পাশের দোকান থেকে একটা ছোটো কেক কিনে তাকে দিয়ে বললাম - এত চ্যাঁচায়? শরীর খারাপ করবে তো। কিছু খাওনি তো এখনও? এটা খাও। সে কেকের আগে থতমত খেয়ে নিয়ে কেকটা নাড়াচাড়া করতে করতে রাস্তার ধারে চলে গেল। আমিও সফল ট্রাফিক কন্ট্রোল সেরে আমাদের ঠাকুরকে সুপ্রভাত জানিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

আমার চোখে ব্রাজিল (২০১৫র লেখা)

 

আমার চোখে ব্রাজিল

মীনা দাঁ

এস্পেরান্তো কংগ্রেস

ব্রাজিল মানে ফুটবল, ব্রাজিল মানে আমাজন রেইনফরেস্ট, ব্রাজিল মানে কফি, ব্রাজিল মানে কার্নিভাল, ব্রাজিল মানে বিশাল দেশ, ব্রাজিল মানে 2016র অলিম্পিক, ব্রাজিল মানে না-জানা আরো কত কি! তবে ব্রাজিল যাবার আগের প্রস্তুতিপর্বে আমার কাছে ব্রাজিল মানে ছিল ব্রজিলের ৫০তম এস্পেরান্তো কংগ্রেস, যেটিতে আমি অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি এবং যেটি অনুষ্ঠিত হবে রিও দি জানেইরোতে। তাছাড়াও নেমন্তন্ন আছে বোনা এস্পেরো থেকে, তাদের প্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার জন্যে। আছে অন্য উত্তেজনাও – রিওতে থাকবো আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী মার্সিয়ার ফ্ল্যাটে, হোটেলে নয়, ওর ছেলে-মেয়ের সঙ্গে। এক্কেবারে খাঁটি ব্রাজিলীয় যাপন! এর আগে বাংলাদেশেও অনেকের বাড়িতে অতিথি হয়ে থেকেছি – ঢাকায় জনাব হাবিবুর রহমানের বাড়িতে তাঁর পুত্র হাসিবের আতিথ্য নিয়ে, কক্সবাজারে ছাত্রের মামাবাড়ি, চট্টগ্রামে তারই মামাতো দিদির বাড়ি। কিন্তু এবারের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। চ্যালেঞ্জটা ভাষার। ব্রাজিলের আসমুদ্র-হিমাচল সরকারি ভাষা একটিই  – পর্তুগিজ। দেশটাতে দেড়শোরও বেশি উপজাতীয় ভাষা থাকলেও কোনোটিরই কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। নিজের মহল্লায় এসব ভাষার ব্যবহার থাকলেও সরকারি ভাষাটা প্রত্যেকেই জানে। আমি ছাড়া! আমি জানি ইংরিজি – বৃটিশ কলোনির উত্তরাধিকার। ব্রাজিল ছিল পর্তুগিজ কলোনি, তিনশো বছরের ওপর। ফলে ইংরিজি কোনো ফাঁকফোকোরই পায়নি সেখানে ঢোকার! অতএব মানুষের ইংরিজি জানার কোনো কারণই নেই। আমার বান্ধবী, তার ছেলে-মেয়ে বা তাদের কম্পিউটার-মোবাইল - কেউই জানেনা। আমার আর মার্সিয়ার কথোপকথনের মাধ্যম এস্পেরান্তো, মার্সিয়ার তেরো বছরের কন্যা মারিয়ানা একটু একটু এস্পেরান্তো জানে আর ছেলে ষোলো বছরের বেরনার্দো সেটুকুও জানেনা। আমার পুরো ভ্রমণটাই এস্পেরান্তো কেন্দ্রিক। আগামী চোদ্দো দিনের জীবনযাপন এস্পেরান্তোতেই।

যাত্রাপথ কলকাতা থেকে দুবাই ছুঁয়ে রিও। 22 জানুয়ারি 2015 রাত আটটা কুড়িতে বিমান আকাশে উঠল। তবে খানিক পরেই শুরু হলো বিষম লাফালাফি, এয়ার পকেটের হুলুস্থুল। তারই মাঝে পাইলটের ঘোষণা – আবহাওয়া খারাপ, আরও উঁচু দিয়ে ওড়ার অনুমতি চেয়েও পাওয়া যায়নি, কারণ এয়ারট্রাফিকের আধিক্য রয়েছে। অতএব এখনো আধঘন্টা এরকমই চলবে। তিন সপ্তাহ আগেই এয়ারএশিয়া বিমান সংস্থার একটি এয়ারবাস খারাপ আবহাওয়া ও আরো ওপর দিয়ে ওড়ার অনুমতি না পাওয়ার কারণেই 155 যাত্রীসহ জাভা সমুদ্রে ভেঙে পড়েছে। সুতরাং ধরেই নিলাম যে এটার ও সঙ্গে আমারও এই শেষ যাত্রাই। সেই মতো মনস্থির করে ভয়কে জয় করার চেষ্টা করতে করতে দেখি একসময় বিমানের চলন মোটামুটি একটা স্থিরতা লাভ করল আর বিমান সেবিকারাও খাবারদাবার দেবার তোড়জোড় শুরু করল। এযাত্রা মানবদেহই বজায় রইল!

দুবাইয়ে সাত ঘন্টার অপেক্ষা। বিমানবন্দর তো নয়, আমাদের অত্যাধুনিক মলকেও হার মানায় তার সাজসজ্জা ও ব্যবস্থাপনায়। ঘুরে ঘুরে দেখলাম খানিক – রেস্টুরেন্ট, গয়নার দোকান, হরেক কিসিমের মদের দোকান, ওই রসে বঞ্চিতরাও সেখানে বোতলের আকার আর রং দেখেই মুগ্ধ হবে, মানি-এক্সচেঞ্জার, ব্যাগ ও উপহারের বিপনী, বাচ্চাদের খেলার জায়গা – পার্কেরই মতো, আর অফুরন্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা – বসার, শোওয়ার। সবকিছুই উজ্বল সাজানো। বিশাল চত্বর। দেওয়ালে আঁকা বিশাল বিশাল ছবি। কয়েক পাক ঘুরে, যাতে হারিয়ে না যাই অন্তত সেইটুকু চোখের চেনা চিনে নিয়ে একটা আধশোয়া হবার মতো চেয়ারে লম্বা হয়ে ঘুমোলাম খানিক। আবার বিমান। এবার টানা সাড়েচোদ্দঘন্টা! দুই মহিলার মাঝে বসেছি। ছটা সিনেমা দেখে, খেয়ে, হাই তুলে, ঘুমিয়ে, আড়মোড়া ভেঙে সাড়েচোদ্দঘন্টা পেরোনো!

রিও বিমানবন্দরে ব্যাগেজ পেলাম প্রায় সবার শেষে। দরজা পেরিয়েই দেখি মার্সিয়া দাঁড়িয়ে, ফুল নিয়ে। কী যে নিশ্চিন্দি! ট্যাক্সি নিয়ে ওর বাড়ি। মানে ফ্ল্যাট, ওরা বলে অ্যাপার্টমেন্ট। একতলায়, ছোটো ছোটো তিনটে ঘর – দুটো শোবার – একটা মার্সিয়ার, অন্যটা ওর ছেলেমেয়ের – সেটাতে বাংকের মতো দুটো শোবার জায়গা আর টেবিল-চেয়ার-আলমারি ইত্যাদি। তৃতীয় ঘরটির ব্যবহার বহুমুখী – খাওয়া-বসা-কম্প্যুটার-টেলিফোন-ফ্ল্যাটের মূল দরজা সব সব। এরই সঙ্গে লাগোয়া রান্নাঘর, ছিমছাম গুছোনো, গ্যাস-ওভেন, মিটসেফের সমগোত্রীয় দুটো পাল্লাদেওয়া আসবাব – তাতে ভাঁড়ার। একদিকের দেওয়াল জুড়ে ঢালাই করা তাক, তাকের প্রান্তে সিংক আর মাঝখানে পোড়ামাটির লম্বা আকারের পানীয় জলের পাত্র – বলা যায় ওদেশিয় কলসি – মুখঢাকা – ওপর থেকে সরু একটা পাইপ এসে ঢুকেছে সেই কলসিতে – তাতে পানীয় জলের সরকারি সাপ্লাই। হ্যাঁ, ঠিকঠাক খাবার জলটা যোগানের দায়িত্ব সরকারের। ঘরে গ্যাস-ওভেন, আসবাব আর এই তাকের উচ্চতা এক। তাকের নিচের দিকে রয়েছে বাসন-কোসোন – যাদের সঙ্গে আমাদের হাঁড়ি-কড়ার কোনোই মিল নেই। বেশিরভাগই হাতল-দেওয়া নানান আকারের সসপ্যান ধরনের এবং আরও রকম রকম জিনিস। রান্নাঘরের অন্য দরজাটি পেরিয়ে একটা ছোটো চাতাল – সেখানে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাথার ওপরে কাপড় শুকোনোর ফ্রেম। চাতালের লাগোয়া এক চিলতে উঠোন। ওই চিলতে উঠোনেই টবে লাগানো বেশ কিছু গাছ – মার্সিয়ার ভালোবাসা। শুধু নিজের উঠোনে নয়, মার্সিয়া গাছ লাগিয়েছে তার ফ্ল্যাটের বাইরে বাড়ির প্যাসেজে, উঠোনে, এমন কি সরকারি রাস্তাতেও। রাস্তার ধারে বড় টবের মতো করা, তাতে মাটি আছে কিন্তু গাছ নেই। মার্সিয়া তার দলবল নিয়ে সেখানে গাছ লাগিয়ে দিয়েছে। তার দলবল বলতে মেয়ে মারিয়ানা আর ছেলে বেরনার্দো। আপাতত তাদের বয়স যথাক্রমে তেরো আর ষোলো। শহরের নানা জায়গায় ওদের পোঁতা আমগাছ আছে। রাস্তায় চলতে-ফিরতে কয়েকবারই শুনেছি – এই রাস্তাটায় আগে কোনো সবুজ ছিল না, ছিল বেশ ন্যাড়া-বোঁচা, আমরা গাছ লাগিয়ে, রোজ জল দিয়ে সার দিয়ে গাছ বড় করে সবুজ করে দিয়েছি। জানো, একবার শেকড়টা ঠিক জায়গায় নেমে গেলে আর দেখভাল করতে হয় না। গাছ তখন আপনাআপনিই বাড়ে। ছোটো ছোটো টবে গাছ ঝোলানো আছে ওর পড়ার টেবিলে, শোবার আর বসার ঘরের জানলায় - সে সব জানলা দিনে বন্ধ হয় না – পাখির অপেক্ষায় উন্মুক্ত।

এস্পেরান্তো কংগ্রেসের সূচনাপর্ব 23 জানুয়ারির সন্ধ্যে ছ’টায়। রিওতে বেলায় পৌঁছলেও কংগ্রেসের সবটুকুই পাবো ভেবে বেশ ভালো লাগল। মার্সিয়া, বেরনার্দো আর আমি ট্যাক্সি করে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট হলে। রিও দি জানেইরো স্টেটের বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ সরকারি, তবে স্বাধীন। বিশাল বাড়ি। লিফটে বারোতলায়। এক বিশাল ঢাকা চত্বরে বারোখানা মুখোমুখি লিফট, আমাদের হাসপাতালে লিফটের মতো বিশাল মাপের, ভিতরে অপারেটর থাকেন। তবে বারোখানাকেই একসঙ্গে চালু অবস্থায় দেখিনি কখনো। ভাগাভাগি করে কাজ করে নিশ্চয়ই। ওপরে উঠে আবার সিঁড়ি দিয়ে আধতলা নেমে এসে এই তল। সিঁড়ি খোলা জায়গায়, আশপাশ দেখা যায়। পাশাপাশি দু-সারি সিঁড়ি ও সঙ্গে ramp। সিলিং, বারান্দা, ঘর সবই বিশালত্বে মোড়া। এই অডিটোরিয়ামটিও বেশ বড়, সামনে প্ল্যাটফর্মে চেয়ার-টেবিল, তার পিছনে বিশাল স্ক্রিন, স্লাইড প্রেজেন্টেশনের জন্যে। আর বসার ব্যবস্থা ধাপে-ধাপে উঁচু গ্যালারিতে। প্ল্যাটফর্মের পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে বসতে হয়। আমাকে আর বেরনার্দোকে গ্যলারির শেষ সারিতে বসিয়ে দিয়ে মার্সিয়া চলে গেল ওর ক্লাসে। ও অনেকগুলো ভাষা শেখে, ভাষা শেখাই ওর নেশা – মান্দারিন, ইটালিয়ান, ফরাসি – তারই কোনো একটাতে ওর প্রেজেন্টেশন আছে আজ, সেরে আবার আসবে। গ্যালারির একেবারে পেছন থেকে হলের সম্পূর্ণটা দেখা যাচ্ছে। কত রকমের মানুষ – সাদা-কালো-বাদামি, লম্বা-বেঁটে, কতরকম চুলের রং – সোনালি-বাদামি-সাদা-কালো, চুলের ধরনও নানান –  সোজা-কোঁকড়ানো-মিহি কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া - যাকে নিগ্রো চুল বলে, নৃতত্ত্বের নিরিখে নানান মুখাবয়ব এবং এসব কিছুর নানান মিশ্রণ। যেমন মার্সিয়ারই নিগ্রো চুল, কিন্তু গায়ের রং সাদা, মুখাবয়বে ভারতীয় বললে অবিশ্বাসের কারণ নেই কিন্তু চেহারায় বিশাল ব্রাজিলিয়। ঈশ্বরের এই সব সৃষ্টিবৈচিত্র্যের পাশাপাশি রয়েছে নানান কিসিমের পোশাকআশাক ও সাজসজ্জা, বিশেষত কেশসজ্জা। প্রায় পুরো পৃথিবী হাজির আর কী! একে তো ব্রাজিলের চরিত্র মেল্টিং পট-এর মতো – পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছে। তার ওপর এস্পেরান্তোচর্চা তো ভাষা-দেশ-ধর্ম-জাতি-নৃনির্মিতি-নাগরিকত্ব-প্রথমবিশ্ব-দ্বিতীয়বিশ্ব-তৃতীয়বিশ্ব – সব কিছুর সীমানাকে অতিক্রম করেই ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবে। অতএব এই দুইয়ে মিলে সারা পৃথিবীর হাজির থাকাটাই তো স্বাভাবিক! আর আমার বিস্ময়টাও স্বাভাবিক কারণ এ আমার প্রথম দর্শন। দর্শনে মুগ্ধতা! এই নজরে বন্দি ছোটো পৃথিবীকে সেলাম জানাতে জানাতেই ভাবছি আমার বক্তৃতাও কি এই বিশাল হলেই হবে নাকি! হবে ভেবে ভয় পাবো না আনন্দ পাবো তাও ঠিক করে উঠতে পারছি না। তবে আপাতত বিদেশি ঠাওর করে সভায় কিছু বলতে বললে একটু বিব্রত হব। যাই হোক, সেরকম পরিস্থিতি আসে নি। অনুষ্ঠান শেষ হলো, একটা লম্বা বক্তৃতা উপভোগও করলাম। ইতিমধ্যে মার্সিয়াও এসে গেল। বহু মানুষের সঙ্গে ও আলাপ করিয়ে দিল। সকলের চোখেই বন্ধুত্বের বিস্মিত ঝিলিক। বারাতো! সে তো অনেক দূর! কথায়-বার্তায় সে দূরত্ব মুছে গেল নিমেষে। এস্পেরান্তো বিশ্বে আমার দেশের নাম বারাতো, অর্থাৎ ভারত, ইন্ডিয়া নয়। আগে হিন্দিও (ইন্ডিয়া থেকে) নামটি ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে সাব্যস্ত হয়েছে যে হিন্দিও নামটি হিন্দি ভাষাকে বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করা হবে, দেশের জন্যে নয়। দেশ হলো বারাতো।

রাতে ফিরে খেয়েদেয়ে শোওয়া। ওই গোলার্ধে এখন গরমকাল। মার্সিয়ার ঘরে বাতানুকুল যন্ত্র। অতএব সকলে মিলে সেই ঘরেই। খাটের ওপর আমি আর মারিয়ানা, মেঝেয় বিছানা পেতে মার্সিয়া আর বেরনার্দো।

মার্সিয়া মান্দারিন শেখে। সকালে ওর সঙ্গে ওর মান্দারিন ক্লাসে আমিও হাজির। চীনদেশীয় শিক্ষিকা, বাও হোং ইয়ুয়ান, নিজের দেশেই ব্রাজিলীয় বন্ধুকে ভালোবেসে, বিয়ে করে, এখন এদেশে থিতু হয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা আদর করে তাঁকে ডাকে ইয়ু বাও বলে। ইনি ইংরিজিও জানেন। একটি অফিস-বিল্ডিং-এ ক্লাসঘর ভাড়া করে মান্দারিন শেখান। সপ্তাহে যে কদিন ক্লাস সে কদিন ভাড়া। একটি সুসজ্জিত বাতানুকুল ক্লাসঘর – বোর্ড-মার্কার-টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চ-ল্যাপটপ চালানো ও তা ব্যবহার করে পড়ানোর উপযুক্ত সব সরঞ্জামসহ। ঘরটি বাড়ির অন্তত পনেরো তলায়, একটি কোণে। ঘরের বাইরে কাঁচের অর্ধেক আড়ালের পাশে কোণে সুদৃশ্য উঁচু উঁচু তেপায়া টুল, টেবিল ও কাউন্টার, দুটি চা-কফি-ক্যাপুচিনোর মেশিন, প্যাকেট করা চিনি, কাগজের গ্লাস, টিস্যুপেপার ইত্যাদি। ক্লাসের সঙ্গে এগুলো ফ্রি, যতখুশি যখনখুশি। বড় বড় জানলা দিয়ে প্রচুর আলো আসছে আর নিচে দেখা যাচ্ছে রাস্তা, গাড়ি আর অসংখ্য গাছের ঝাঁকড়া সবুজ মাথা। সামনে পাহাড়। আমার মনে হলো যেন সেই বিশ্ববিখ্যাত যিশুর মূর্তিটাও দেখতে পাচ্ছি অনেক দূরে, আবছায়া। এই বাড়ির নিচে কড়া নিরাপত্তা। নিজের পরিচয় লিখে, কার্ড পাঞ্চ করে তবেই লিফ্টে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। আমার জন্যে বিশেষ অনুমতি নিল মার্সিয়া। ওপর তলায় লিফ্ট থেকে বেরিয়ে চাতালের একদিকে ছোটো রিসেপশন টেবিল। সেখানে জিগেস করে বা জানিয়ে নিজের গন্তব্য ঘরে যেতে হয়। এই টেবিলে একটা বড় বাটিতে টফি রাখা, ইচ্ছেমতো তুলে নেওয়ার জন্যে। এই মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা পরেও নানান রিসেপশন টেবিলে দেখেছি। মার্সিয়া ক্লাস করল আর আমি পিছনের বেঞ্চে বসে আমার ল্যাপটপে কাজ করলাম। ক্লাসের শেষে বাকিদের সঙ্গে আলাপচারিতা, ছবি তোলা ও কফি পান।

এরপরের গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এস্পেরান্তো কংগ্রেস। সেখানে পৌঁছে দেখি সিঁড়ির সামনের বিশাল চাতালে একেবারে মেলা বসে গেছে। ছোটো ছোটো টেবিলে অনেকে হরেক রকম এস্পেরান্তো বই-পত্রিকা, টিশার্ট, ব্যাজ, মেমেন্টো সব সাজিয়ে বসেছেন। একদিকে রয়েছে রেজিস্ট্রেশন টেবিল। সেখানে ‘আলিজিলো’ বলে যোগদানের ফর্ম পূরণ করলাম কিন্তু টাকা দিতে পারলাম না কারণ আমার কাছে ব্রাজিলের রিয়াল নেই, আর ওদের কাছে ইউরো নেই। তবে পেমেন্ট বাকি থাকলেও টেবিলের মহিলা ‘মি ফিদাস ভিন’ (আমি তোমাকে বিশ্বাস করি) বলে রেজিস্ট্রেশনের রিসিটটা আমাকে দিয়ে দিলেন। তারপর গেলাম ব্যাগ ও পেনের টেবিলে। কংগ্রেসে যোগদানকারীদের দেওয়া হচ্ছে এসব। খানিক আলাপচারিতার পরে সে টেবিলের মহিলা বললেন যে এখুনি তিনি আমাকে এসব দিতে পারছেন না, তবে আমার নামটা তিনি লিখে নিতে চাইলেন। আমি একটা প্রোগ্রাম-পুস্তিকা খুলে তাতে ছাপা আমার নামটা ওঁকে দেখালাম, দেখলেন। তারপর আমি চলে গেছি অন্য টেবিলে, ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে। হঠাৎ তিনি এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ওনার টেবিলে এবং আমাকে ব্যাগ-পেন-আমার নামের ট্যাগ দিয়ে দিলেন। আরো খানিক ঘোরাঘুরি করে বেরোলাম মার্সিয়ার সঙ্গে। এবার তাগমাঞ্জো বা মধ্যাহ্নভোজনের পালা। ঘুরে ঘুরে দেখে ৎসেনত্রা উর্ব বা সিটি সেন্টারে রেস্টুরেন্টে খেতে ঢোকা হলো। বুফে সিস্টেমে খাওয়া, তবে আমাদের চেনা বুফের চেয়ে আলাদা। দুধারে খাবার সাজানো, স্টিলের বড় বড় চৌকো ট্রেতে, বড় চামচসহ, যেরকম থাকে। তাতে আমিশ-নিরামিষ পদও যেমন আছে তেমনই আছে নানান রকমের টুকরো করে কাটা ফল ও সবজি সিদ্ধ। যে যা খাবে তুলে নাও, একলপ্তেই তুলতে হবে, তারপর প্লেট নিয়ে কাউন্টারে যাও, সেখানে ওজন হবে, ওজন অনুযায়ী দাম দাও, কোক ইত্যাদি কোনো নরম পানীয় নিলে তার দাম আলাদা, তারপর ভিতরে টেবিল-চেয়ারে বসে খাও। সব রকম মাংস, অসংখ্য চেনা-অচেনা সবজি, কয়েক পদ মিষ্টি – সব এক দাম! কয়েক দিনই এই সিস্টেমে খেয়েছি। এছাড়াও শহরে আছে নির্দিষ্ট দাম ধরে দিয়ে যত খুশি খাওয়ার বুফে সিস্টেমের রেস্টুরেন্ট। যেমন আমরা চিনি। আর আছে আলাকার্ত – পদ অনুযায়ী দাম দিয়ে খাওয়ার রেস্টুরেন্টও।

আজ রবিবার। এস্পেরান্তো কংগ্রেসের ব্যবস্থাপনায় আজ শহর বেড়ানোর আয়োজন। কিন্তু মার্সিয়া কালই আমাকে বলেছে যে ওরা এর জন্য বড্ড বেশি টাকা নিচ্ছে। তাই ও আমার যাওয়াটা ঠিক মনে করছে না। আমরা পরে বেড়াবো। উত্তম প্রস্তাব। আমারও একটা দিন দরকার নিজের জন্যে। সকালে উঠে মার্সিয়ার সঙ্গে হাঁটতে গেলাম পার্কে। বিশাল লোহার গেট পেরিয়ে বিশালতর পার্ক। সাজানো-গোছানো-পরিচ্ছন্ন, এর মধ্যেই রয়েছে চিড়িয়াখানা, একটা প্রাচীন রাজপ্রাসাদ, আপাতত একটা সার্কাসও তাঁবু ফেলেছে এই চৌহদ্দির ভিতরেই। পার্কের ভিতরে চওড়া রাস্তা, একপাশে গাড়ি পার্কিং। ঢুকেই একদিকে একটা বড় জলাশয় – তার মাঝখানে আমাদের প্রিন্সেপ ঘাটের মতো বিশাল লম্বা থামওয়ালা একটা দালান – রাস্তা থেকে সেখানে পৌঁছোনোর সুদৃশ্য ব্রিজ। অসংখ্য গাছগাছালি ও বৃক্ষ। আমগাছ ভর্তি আম ঝুলছে, গাছের নিচে পড়েও আছে অসংখ্য। কালোজাম গাছের নিচে ঝরে পড়া থেঁতলানো জাম। আম কুড়োলাম। প্রাতর্ভ্রমণরত পুরুষ-মহিলা সকলেরই পরনে গ্রীষ্মের পোশাক – হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি, মেয়েদের অনেকেরই আমাদের হিসেবে অন্তর্বাসটুকুই, পুরুষেরা অনেকেই খালিগায়। কিন্তু প্রত্যেকের পায়ে অবশ্যই জুতো। অন্যের পোশাক নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, কেই কারোর দিকে তাকায়ও না।

পার্ক থেকে বেরিয়ে বাজার করা। এই এলাকায় বিগবাজার বা স্পেনসার্সের মতো ছোটো ছোটো দোকান – কোনোটিতে শুধুই সবজি আর ফল, কোনোটিতে মাছ-মাংস, কোনোটিতে আবার এসবের সঙ্গে আইসক্রিম, বিস্কুট এমনকি ফুল ইত্যাদিও রয়েছে। এরকম মুদির দোকানও আছে। কেনাকাটা সেরে বাড়ি। প্রাতরাশে আমি খেলাম তিনটে কুড়োনো আম আর দোকান থেকে কেনা একটা আতা – মাপে যেটা ওই তিনটে আমের সমান!

মার্সিয়া ফোন করেছে এখানকার রামকৃষ্ণ বেদান্ত মিশনে। আজ বিকেলে যাবো। যিনি মিশনের দেখাশোনা করেন তাঁর নাম লুইস। অনেক বয়স হয়েছে। যথেষ্ট উৎসাহী। রোজ আসেন না। আজ আসবেন, তাই আমাদের আজই যেতে বলেছেন। লুইস সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারী নন, গৃহী ভক্ত। এখানে যাঁরা আসেন সকলেই তাই। দীক্ষিত হওয়ার বাসনায় বা বাধ্যবাধকতায় কেউ আসেন না এখানে, কেউ হিন্দুও নন। যাঁরা আসেন তাঁরা নিছকই এই দার্শনিকতাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে আসেন ও নিয়মিত এই দর্শনের চর্চা করেন। যুবক-যুবতী, মধ্যবয়স্ক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ – সব বয়সের পুরুষ-মহিলাই আসেন। প্রতিদিনই নির্দিষ্ট কিছু পাঠ ও সকলে মিলে তার আলোচনা হয়। মুঠিতে ফুল গুঁজে বা করজোড়ে প্রশ্নহীন আনুগত্যপূর্ণ পুণ্যার্থী প্যাসিভ শ্রোতা কেউ নন। বরং নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে দর্শন বুঝে নেবার ছাত্র সবাই। লুইস প্রথমে আশ্রমটা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। দোতলা, তবে পাহাড়ি জায়গায় যেমন হয়, দুদিকেই রাস্তা, গাড়ি করে দুটি তলাতেই সরাসরি নামা যায়। নিচে কয়েকটা অতিথিঘর, ভোগের রান্নাঘর, প্রেয়ারহল, ওপরে সোফা-চেয়ারশোভিত মিটিং-এর জায়গা, তার পাশেই ছোটো লাইব্রেরি, খাবারঘর, রান্নাঘর, প্যাসেজ পেরিয়ে কারপার্ক। আজ প্রথমে মিটিং। লুইস আমার পরিচয় দিলেন। নিবেদিতা প্রতিষ্ঠিত স্কুলের কথা উল্লেখ করে বললেন যে সেই স্কুল এখনো আছে কিনা তা তিনি জানেন না। সবই পর্তুগিজ ভাষায়। মার্সিয়া এস্পেরান্তোতে তর্জমা করছিল আমার কানে কানে। এরপর আমি ইংরিজিতে আমার সম্বন্ধে ও নিবেদিতা স্কুল সম্বন্ধে বললাম। আমি যে নিবেদিতা স্কুলের ছাত্রী তাও বললাম। একজন সদস্য যিনি ইংরিজি জানেন তিনি আবার আমার বক্তব্য পর্তুগিজে তর্জমা করে অন্যদের শোনালেন। তারপর শুরু হলো কোনো স্বামীজীর লেখার পর্তুগিজ তর্জমা থেকে পাঠ করে সাধনা ও ধ্যান সম্বন্ধীয় আলোচনা। মার্সিয়া অবিরত আমার কানে কানে এস্পেরান্তোতে তর্জমা করে চলেছে আলোচনার বিষয়বস্তু। শেষে ও বলল আমি যেন কিছু মতামত প্রকাশ করি। বললাম যে ধৈর্য, ফোকাস আর পরিশ্রম ছাড়া কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছোনো যায় না। আবার যথারীতি ইংরিজি থেকে পর্তুগিজে তর্জমা।

এবার নিচের প্রেয়ারহলে। বেদির ওপর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও বিবেকানন্দের ছবি। আরতি হবে এখন। শর্টস-টিশার্ট পরা একটি অল্পবযসী মেয়ে গায়ে একটা সাদা চাদর জড়িয়ে নিয়ে আমাদের মতোই সব উপকরণসহ আরতি করল। সঙ্গে বাজনা সহযোগে গান। এই সদস্যরাই চেনা-অচেনা নানা ধরনের বাজনা বাজিয়ে খাতা দেখে একের পর এক রোমান লিপিতে লেখা বাংলা গান করলেন। আমাকেও খাতার একটা পাতা দিলেন। গলা মেলালাম। গান শেষে প্রণাম করে আবার দোতলায়। এবার খাবার ঘরে। এখন প্রসাদ পাবার পালা। টেবিল ঘিরে বসে কেক, বিস্কুট, বিস্কুটে মাখিয়ে খাবার দুরকম ক্রিম, পাঁউরুটি, কোকাকোলা, ফলের রস। খেয়ে যে যার বাসন ধুয়ে রাখা। এঘরেও মা বসে আছেন ছবিতে, তাঁর সেই চিরপরিচিত পা-ছড়ানো আপ্যায়নের ভঙ্গিতে। এই অতিস্বল্পবসনা ভক্তদের নিয়ে তাঁর কোনো অস্বস্তি আপত্তি নেই। তিনি তাঁর হৃদয়ের দরজা হাট করেই বিরাজমানা। হৃদয়ের কপাট খোলা ভক্তদেরও। তাই তো সর্বত্র এত খোলা হাওয়ার সহজ আনাগোনা! এত আন্তরিকতা! যে যেমন খুশি ঘুরছে, কেউ বা সোফায় শুয়ে দুমিনিট ঘুমিয়েও নিচ্ছে। কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে চিত্ত হেথা ভয়শূন্য, দ্বিধাহীন, নিজের পূর্ণ অস্তিত্ব ও আয়তনসহ সদাজাগ্রত। সবাই স্বাধীন, তবু এক দার্শনিকতা ও বিশ্বাসের সূত্রে বাঁধা। দেখছি আর মনে প্রশ্ন জাগছে আমাদের মঠে-মন্দিরে কেন এত নিয়মের কড়াক্কড়ি, কেন এত গম্ভীর গম্ভীর মুখ? হৃদয়ের ভাগে কিছু কম পড়ে বলেই কী?

আজ ছাব্বিশ তারিখ। আজ কংগ্রেসের শুরু আমার বক্তৃতা দিয়ে। টেনশন আছে। সকালে আভোকাদো (এস্পেরান্তো নাম এটা) ফলের পাল্পে চিনি-লেবু মিশিয়ে খেয়ে বেরিয়েছি। সেই প্রথম দিনের কংগ্রেস উদ্বোধনের গ্যালারি। গ্যালারি কানায় কানায় ভরা। আমি তাদের মুখোমুখি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, পিছনে স্ক্রিন, সামনে মার্সিয়া আমাকে সাহায্য করছে স্লাইড শোতে। প্রেজেন্টেশন বেশ ভালোভাবেই  হলো। ‘লিংভা কাই কুলতুরা দিভেরসেৎসো এন নুনতেম্পা বারাতো’ অধুনা ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। স্লাইড প্রেজেন্টেশন, শেষে রয়েছে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের কয়েকটি ভিডিও। প্রেজেন্টেশনের শেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। আমার সবচেয়ে বেশি টেনশনের মুহূর্ত। কারণ আমার অভ্যেস নেই গড়গড় করে এস্পেরান্তো বলার, কলকাতায় সে সুযোগও নেই। এই কদিনে মার্সিয়ার সঙ্গে বলে বলে খানিক রপ্ত হয়েছে। গত দুদিনে মার্সিয়া আমার স্লাইডগুলো দেখে প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধনও করে দিয়েছে। যাই হোক, সে-পর্বও সমাধা হলো নির্বিঘ্নেই। সে এক অভিজ্ঞতা! তার ফর্মেও, কনটেন্টেও। বক্তৃতা শেষে আমিই জিগেস করলাম কার কী জিজ্ঞাস্য। বিশাল গ্যালারিতে আমিই প্রশ্নকর্তাদের কাছে চলে গেলাম তাদের হাতে মাইক তুলে দিতে, তারপর আমি উত্তর দিলাম। আর প্রশ্নের কনটেন্টে? কয়েকটি প্রশ্নের নমুনা দিই। ভারতে রোজ কতজন ইংরিজি বলে? আমি এস্পেরান্তোর খবর পেলাম কী করে? শিখলাম-ই বা কী করে? লিংগুইস্ট হিসেবে আমি এস্পেরান্তোকে জরুরি মনে করি কিনা? কেন করি? ভারতের ভাষাতে অ্যাক্যুসাটিভ বা কর্মকারকে বিভক্তির প্রয়োগ কতটা হয়? এটা ছিল শেষ প্রশ্ন। বললাম আমার ভাষাতে এটা আবশ্যিক নয়, তাই আমি এস্পেরান্তো অ্যাক্যুসাটিভে ভুল করে ফেলি। সবাই মজা পেল। আমি তাঁতের জংলা কাজ করা শাড়ি পরে রয়েছি, তারও প্রশংসা হলো। আবার প্রশ্নও হলো যে এটা কি তোমার দেশের শীতের পোশাক? অবশ্যই এর আপাদলম্বিত বিস্তার হেতু। মহিলারা কি রোজই এরকম পোশাক পরে, নাকি এটা উৎসবের পোশাক? সামলায় কী করে? তোমার দেশে কি প্যান্টপরা মহিলা দেখা যায়? পোশাক নিয়ে কৌতূহল আগে-পরে অনেক দেখেছি। আমি অবশ্য শাড়ি একদিনই পরেছি। অন্য সময়ে আমার লং-স্কার্ট বা সালোয়ার-স্যুট দেখে সবাই সেগুলিকে শীতের পোশাক বলেই সাব্যস্ত করত। ওরা লম্বা পোশাক শীতের দিনে ব্যবহার করে। ব্রাজিলে এখন গ্রীষ্মকাল, অর্থাৎ অন্য গোলার্ধে শীত। অতএব আমি শীতের পোশাক পরেই চলে এসেছি! তবে এই রকম শ্রোতাদের কাছে বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর সাঙ্গ করা এক অপূর্ব অনন্য অভিজ্ঞতা! অন্য যাপনের ছন্দে মিলিয়ে চলতে পারার আনন্দ। ভিন্ন রকম বাঁচা! জীবনের এক পরম প্রাপ্তি! এস্পেরান্তো কীভাবে এবং কতটা সমৃদ্ধ করতে পারে মানুষকে তা প্রত্যক্ষ করলাম!

ফর্মাল প্রশ্নোত্তরপর্ব শেষ হলেও অনেকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গ্যালারি থেকে বেরলাম। বেশ কয়েকজনই মন্তব্য করেছেন যে এ-পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বক্তৃতা এইটা। হতেই পারে। বৈচিত্র্য তো আমার দেশে কম নেই। সেই বৈচিত্র্যের গুণেই নানান রঙে উজ্জ্বল হয়েছে বক্তব্য। আজ দেখি সিঁড়ির সামনের চাতালে বই-টিশার্ট ইত্যাদির পাশাপাশি খাবারদাবারও রয়েছে অল্পস্বল্প, কংগ্রেসেরই উদ্যোগে এবং নিখরচায়। কেক, কফি, চিজ, কিছু স্লাইসড মিট খেলাম। কটা বই ও টিশার্ট কিনলাম। ভিতরে বেশ গরম, তাই বাইরের খোলা ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। বারোতলার ওপরে অজস্র ঠাণ্ডা হাওয়া, নিচে বিছোনো শহর – রাস্তা-পার্কিং-বাস-গাড়ি-বিপনী। সামনে দৃষ্টি আটকে যায় সবুজ পাহাড়ের সারিতে, দূরে নয়, পাহাড়ের গায়ে ঘরবাড়ি আর মাথায় অগুনতি টাওয়ার।

এটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বিনামূল্যে । কিন্তু যোগ্যতা-পরিচায়ক দুরূহ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবেই পঠনপাঠনের সুযোগ পাওয়া যায়। অনুত্তীর্ণদের জন্যে আছে খরচসাপেক্ষ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। মার্সিয়া এখানকার ছাত্রী। চাকরি থেকে অবসরের পর বিভিন্ন ভাষা শিখছে।

আজ বিকেলে কংগ্রেসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লাসঘরে বোনা এস্পেরোর ওপর বক্তৃতা। ওখান থেকে এসেছেন দুজন বক্তা – শের্জো আর আলেকসান্দের। স্লাইডসহ বোনা এস্পেরো সম্বন্ধে বললেন। প্রশ্ন-উত্তরপর্ব শেষে আমি আর মার্সিয়া আলাপ করলাম ওঁদের সঙ্গে। ওঁরা জানেন কংগ্রেসের শেষে আমরা যাবো বোনা এস্পেরোতে। বিমানের টিকিট কাটা আছে কিন্তু বাকি পথের হদিশ মার্সিয়ার তেমন জানা নেই। সেসব খোঁজখবরও নেওয়া হলো।

আজ সাতাশ তারিখে কংগ্রেসের সকাল শুরু সিনিওরিনো (শ্রীমতি) তাতিয়ানা লোস্তুকোভা নামে এক রাশিয়ান মহিলার বক্তৃতা দিয়ে। রাশিয়া থেকে এসেছেন ইনি, এস্পেরান্তো জগতের যথেষ্ট কৃতী সদস্য। বলবেন রাশিয়ার ভাষা বৈচিত্র্য বিষয়ে। কী ভালো সব স্লাইড নিয়ে এসেছেন – কত শহর-নগরের, কত স্মৃতিসৌধের, কত রকম পোশাক-আশাক, আর নাচ-গানের ভিডিও! যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি, আর মনে মনে ভাবছি ভাগ্যিস আমার প্রেজেন্টেশনটা আগে হয়েছে! এই সব প্রফেশনাল ছবির পাশে আমার আনা ছবি! বক্তৃতার শুরুতে উনি আমার বক্তৃতার উল্লখ করে বললেন যে দুজনের বক্তৃতার নামটা এক হলেও বিষয়টা কিন্তু আলাদা। সে তো হবেই। দেশ দুটোই তো আপাদমস্তক আলাদা! এ তো ভিন জগতের গপ্পো। বক্তৃতা শেষে কথা বললাম ওঁর সঙ্গে। দেখলাম উনি আয়োজকদের ওপর একটু বিরক্তই, কারণ ওরা ওঁকে জানায়নি যে ভাষা-বৈচিত্র্য নিয়ে আরও একটা বক্তৃতা রয়েছে অনুষ্ঠানসূচিতে। জানলে উনি অন্য বিষয়ে বক্তৃতা করতেন।

আজ সকালে এক ডাক্তারের বক্তৃতা শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সুযোগ হয় নি। সে সময়ে এস্পেরান্তো সংস্থার সেক্রেটারি সিনিওরো (শ্রী) ফেরনান্দো পিতা-র অফিসে বসে সার্টিফিকেট ইত্যাদি জরুরি কাগজপত্র প্রস্তুত ও সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম। দুপুরে আবার একটা ইন্টারভিউ আছে আমার। স্পিরিতা ফেদেরাৎসিও-র রেডিও স্টেশন এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী জনকয়েকের সঙ্গে আমারও ইন্টারভিউ নেবে। ব্যবস্থা করেছেন সিনিওরো জিভালিন্দো। সদা হাস্যময় আন্তরিক মানুষ। স্পিরিতা ফেদেরাৎসিও একটি সংস্থা বা ফেডারেশন যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও কিছুটা দর্শনেরও চর্চা হয়। অনেক মানুষই এস্পেরান্তো ও স্পিরিতা ফেদেরাৎসিও – এই দুই সংস্থারই সদস্য। মার্সিয়াও। কারণ এই দুই সংস্থার নিজস্ব দর্শনে ও কাজকর্মে অনেক মিল। অহিংসভাবে সকলকে নিয়ে এগোনোই এদের লক্ষ্য।

স্পিরিতা ফেদেরাৎসিও-র নিজস্ব বিশাল অট্টালিকায় পৌঁছোলাম। সারি সারি কাঠের চেয়ার পাতা বিশাল হলঘর। আমরা সবার আগে পৌঁছেছি। তবে আস্তে আস্তে লোকজন আসছেন। স্টেজের পিছনে, হলের এক কোণে ছোটো একটি ঘর। তার বিশাল বিশাল জানলা-দরজা, লাগোয়া ওয়াশরুম। ঘরে টেবিল-চেয়ার, বুককেস, টেবিলের ওপর দুটো টেলিফোন। আমি তো স্টুডিও খুঁজছি। সে সব নেই! ওই দুটি টেলিফোনই মূল যন্ত্রপাতি। ইন্টারভিউ শুরু হলো। জিভালিন্দোই ইন্টারভিউ করবেন, একটি টেলিফোনে উনি। অন্যটিতে যার ইন্টারভিউ নেবেন তিনি। বিষয়বস্তু ঘটমান এই এস্পেরান্তো কংগ্রেস। প্রথমে দুজনকে ইন্টারভিউ করলেন, তারপরে সেই ডাক্তারকে, আমি প্রায় যার প্রেমে পড়ে গেছি, তারপর মার্সিয়াকে সবশেষে আমাকে। প্রশ্নগুলো মোটামুটি আগেই দিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে, তাই অসুবিধে হয় নি। আমার লাস্তা ভোর্তো, মানে শেষ কথা ছিল – সর্বে ভবন্তু সুখীন:, এস্পেরান্তোতে বোঝালাম। এরপর হলে বসে গান শুনলাম, এক মহিলা গাইলেন বজ্রকণ্ঠে। পরে শুনলাম ওনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কিন্তু কী সুঠাম চেহারা আর কী প্রশংসাযোগ্য গলা! আজকের প্রধান বক্তা হলেন - সকালে যাঁর বক্তৃতা শুনতে চেয়েছিলাম কিন্তু হয়ে ওঠেনি - সেই ডাক্তার। নাম তাঁর এলমির দোস সান্তোস লিমা। কালো মানুষ। অসম্ভব রকমের কর্মী মানুষ। অধিকাংশ কাজই নানান ধরনের সমাজসেবামূলক। সকলের অসীম শ্রদ্ধার পাত্র তিনি। বক্তৃতায় গান্ধীজীর উল্লেখ করলেন। শেষে অনেকের সঙ্গে আলাপ ও ফটো তোলা। ডাক্তারকে একটি ভারতীয় টাকা উপহার দিতে গেলাম। উনি গান্ধীজীর ছবি দেওয়া টাকা চেয়ে নিলেন। তারপর নিচের তলার হলে। সেখানে অল্পস্বল্প খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল। কোকাকোলাসহ সেসব খেয়ে রাস্তায়। বাজারের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, নানান দোকানে উঁকি দিতে দিতে, এটা ওটা চাখতে চাখতে বাড়ি ফিরলাম। আজই কংগ্রেসের সমাপ্তি। রাতে তাই কংগ্রেসের তরফে নাচা-গানা-খানা-পিনা আছে। তবে আমরা যাবো না। কারণ, প্রথমত, মার্সিয়া ওই হুল্লোড়-দুনিয়ার মানুষই না। দ্বিতীয়ত, কাল ভোর সাড়েছটায় আমাদের উড়ান। উঠতে হবে অনেক ভোরে। যাবো ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিলের রাজধানী। সেখান থেকে বোনা এস্পেরো। চারদিন পরে আবার রিওতে ফিরবো। এস্পেরান্তো কংগ্রেস শেষ হয়েছে। রিওর প্রথম পর্বের ইতি হবে কাল ভোরে।

বোনা এস্পেরো

বোনা এস্পেরো এই মুহূর্তে আমার পৃথিবীর অংশ, আমার যাপনের অঙ্গ, আমার স্বপ্নের বাস্তব নাকি আমার বাস্তবের স্বপ্ন!

রিও দি জানেইরো থেকে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়া। সেখান থেকে গোইয়াস স্টেটের উত্তরদিকের এক মিউনিসিপ্যালিটি, নাম যার আলতো পারাইসো – এই হলো যাত্রাপথ, বেশ লম্বা, ব্রাসিলিয়া থেকে 230 কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। 1960 থেকে সমুদ্র পাড়ের রিও দি জানেইরো থেকে ব্রাজিলের রাজধানী চলে আসে ব্রাসিলিয়ায়। প্রান্তবর্তী শহর রিওর তুলনায় ব্রাসিলিয়া দেশের অনেক বেশি মাঝমধ্যিখানে, রাজধানী হিসেবে সুবিধেজনক অবস্থানে।

ভোর চারটেয় উঠে তৈরি হয়ে শুনশান রাস্তায় ট্যাক্সি ধরে বিমানবন্দর। বিমানে ব্রাসিলিয়া বিমানবন্দর। এবার ট্যাক্সিতে ব্রাসিলিয়ার দূরপাল্লার বাসটার্মিনাস। বাসে আলতো পারাইসো পৌঁছে, আবার কুড়ি কিলোমিটার গাড়িতে পাড়ি দিয়ে বোনা এস্পেরো। ব্রাসিলিয়ার বাসটার্মিনাস ব্যবস্থাপনায় বিমানবন্দরের মতোই প্রায় – ঝাঁ চকচকে, দোকানের সারি, নজরদারি, অপেক্ষার জায়গা, টিকিট কাউন্টার, শৌচালয়, সাজানো, পরিচ্ছন্ন, নি:শব্দে ও সময়ানুসারে অসংখ্য বাস আসছে যাচ্ছে। সবই বাতানুকুল বড়ো ভলভো বাস। আমাদেরটি সময়মতো এসে নির্দিষ্ট লেনে ঢুকে দাঁড়াল। ধপধপে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো টাই পরা সুবেশ, সুদর্শন ড্রাইভার নেমে এসে দরজার পাশেই রাখা টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে গেল। এটাই তার কাউন্টার। একে একে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করে বাসে চড়তে দিল, তারপর নিজে উঠে দরজা বন্ধ করে বাসে স্টার্ট দিল। বাসে সিট নম্বর মিলিয়ে বসা, আরামদায়ক সিট, রাস্তাও আগাগোড়া মসৃণ, ঝাঁকুনি নেই। শহর ছেড়ে গ্রামের সীমাহীন সবুজের মাঝখান দিয়ে বাস চলল। দুপাশে প্রধানত আদিগন্ত বিস্তৃত চাষের ক্ষেত। এই মরসুমে অধিকাংশই সোয়াবিন। কিছু জমি ফাঁকা। আমাদের মতো আল দিয়ে বাঁধা টুকরো টুকরো জমি নয়, একলপ্তে যত-দূর-দেখা-যায় ততখানি জমি। কোনোটি ফসলের রঙে গাঢ় সবুজ, আর কোনোটি ফসলহীন, লালচে। আমাদের লাল মাটির দেশের মতোই এখানকার মাটিও লাল। বাস মাঝে একবার দাঁড়াল, আধঘন্টার বিশ্রাম - খাওয়া, কেনাকাটা, হাত-পা খেলানো ইত্যাদি।

আলতো পারাইসো বাস স্টেশনে নেমে দেখি পৃথিবীর এক পরম বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষা করছে! স্বয়ং জুসেপ্পে এসেছেন গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিতে। আশি বছর পেরিয়া যাওয়া মানুষটি, আমার স্বপ্নের সেই মানুষটি, আমার কাছে যিনি ভালোবাসার আরেক নাম, সেই তিনি আমাদের সামনে! জুসেপ্পে আর উরসুলা, স্বামী-স্ত্রী, দুজনে মিলে এক টুকরো পৃথিবীকে সাজিয়েছেন মানুষের জন্যে, জীবনের জন্যে। সেই টুকরো পৃথিবীর নামই বোনা এস্পেরো – বাংলায় উত্তম আশা!

আলতো পারাইসো মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্গত সমুদ্রতট থেকে খানিক উঁচুতে পাহাড়ের ওপর বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে বোনা এস্পেরো – সরকারি নথিপত্রে যার পরিচয় এস্পেরান্তো ভাষা-নির্ভর ছোটোদের আবাসিক স্কুল হিসেবে। তবে সরকার এটিকে অনাথাশ্রম, সংশোধনাগার, স্কুল – নানাভাবেই ব্যবহার করে। এটির পত্তন করেন এস্পেরান্তো-ভাষী একটি দলের সদস্যরা, 1957-এ, মূলত আলতো পারাইসো অঞ্চলের নিরক্ষর পিছিয়ে থাকা কৃষ্ণকায় উপজাতির বাচ্চাদের জন্যে। সে সময়ে এই জনগোষ্ঠীর যত বেশি নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য তত বেশি সন্তান-সন্ততি। মহিলাদের আঠেরো-ঊনিশটি করে বাচ্চাকাচ্চা। নড়বড়ে পারিবারিক বন্ধন। বাচ্চারা বাপ-মা থেকেও অনাথ। অনেক বাচ্চারই বাবা কে তা জানা নেই। ফলে নেশাভাঙ, অপরাধ, অশান্তি ও অস্বাস্থ্য জীবনযাপনের নিত্য সঙ্গী। এদের জন্যেই এই আবাসন। কোনো কোনো বাবা বা মা ছেলেমেয়েদের এই নরকের জীবন থেকে মুক্তি দেবার জন্যে তাদের এখানে রেখে যেত। কখনো কোনো মা স্বামীর অত্যাচার থেকে সন্তানদের রক্ষা করতে বা স্বামী-পরিত্যক্তা মা সন্তানদের অনাহারে মৃত্যুর থেকে বাঁচাতে এখানে রেখে যেত। আবার দেশের বিচারালয়ও অনাথ ও অপরাধী শিশুদের এখানে পাঠাত, এবং তাদের জন্যে মাথাপিছু খরচার টাকাও দিত। তবে মূলত এস্পেরান্তোভাষীদের সহায়তাতেই এটি চলত।  

জুসেপ্পে গ্রাত্তাপালিয়া ইতালির মানুষ আর উরসুলা জার্মানির। দুজনেই এস্পেরান্তো চর্চা করতেন খুব ছোটো থেকে এবং দুজনের আলাপ এস্পেরান্তোর মাধ্যমে। দুজনেই শৈশবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতার সাক্ষী ও ভুক্তভোগী। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই দুজনেরই আন্তরিক প্রয়াস বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার। আর সেই প্রয়াসে দুজনেরই হাতিয়ার এস্পেরান্তো। এই সব দর্শনের ও মনের মিলের ফলশ্রুতি হলো ওঁদের প্রেম ও বিবাহ। ওঁদের দুই ছেলে – গুইদো ও দারিও। জুসেপ্পে ছিলেন ইতালির ফিয়ট গাড়ি-কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। আর উরসুলা দশটা ভাষা জানেন, এখনও ছটা ভাষা গড়গড় করে বলেন, তিনি তখন আন্তর্জাতিক স্তরে বহু দিন যাবৎ দোভাষী ও অনুবাদকের কাজ করছেন। দুজনেই সমাজের উচ্চকোটির মানুষ। কিন্তু দুজনের কেউই এত সম্মান-অর্থ-প্রতিপত্তি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, ওঁরা চাইতেন মানুষের জন্যে কিছু করতে। এস্পেরান্তোর সূত্রেই ওঁরা বোনা এস্পেরোর খবর জানতে পেরে ছেলেদের নিয়ে বোনা এস্পেরোতে 1973-এর ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে আসেন। এসে দেখলেন এখানকার বাচ্চারা অপুষ্টির শিকার। পরিচালকেরা আবাসন পরিচালনায় দক্ষ নয়। অজস্র প্রাকৃতিক সম্পদের যোগান থাকা সত্ত্বেও তার কোনো সদ্ব্যবহার নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানটি রীতিমত ধুঁকছে। এসব দেখে বোনা এস্পেরোকেই তাঁরা নিজেদের কাজের জায়গা বলে বেছে নিলেন। পরের বছর, অর্থাৎ 1974-এর জুলাইয়ে বিশাল চাকরি ছেড়ে দিয়ে, বাড়িঘর-আসবাব বেচে, ছেলেদের নিয়ে তাঁরা ইতালির পাট চুকিয়ে চলে এলেন দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের আলতো পারাইসোর বোনা এস্পেরোতে, সেই অঞ্চলের মানুষের জন্যে কাজ করতে। ছেলেদের বয়স তখন বারো আর ষোলো। ব্রাসিলিয়াতে একটি ফ্ল্যাট কিনে, সেখানে দুই ছেলেকে রেখে, তাদের পর্তুগিজ-মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে নিজেরা থিতু হলেন বোনা এস্পেরোতে। ওই বারো আর ষোলো সেই তখন থেকে নিজেরাই নিজেদের সামলায়, স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে শেখে। তারা এখন মস্ত মানুষ। জুসেপ্পে ও উরসুলা মাসে একবার করে ছেলেদের খোঁজখবর নিতে যেতেন। তাদের বাকি সময় কাটতো পরের ছেলেমেয়ে মানুষ করে। এই ছেলেমেয়েদের তাঁরা লেখাপড়া শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন গাছ পোঁতা, যত্ন করা, চাষ করা, ফল ও ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, রান্নাঘরে কাজ করা, খাবারের গুণাগুণ, স্বাস্থ্যসম্মত যাপন, বাড়ি তৈরি, জমি তৈরি, ব্রিজ তৈরি, পাম্প তৈরি, গাড়ি সারানো – বাস্তবে মানুষের মতো বাঁচার জন্যে যা যা প্রয়োজন সব সব। তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে করতে তাদেরও শিক্ষা দিয়েছেন পাশাপাশি প্রকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে বোনা এস্পেরোর জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছেন। জুসেপ্পের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার ও উরসুলার পরিচালন দক্ষতার প্রয়োগ ক্ষেত্র এই বোনা এস্পেরো। বন্য জন্তু, সরীসৃপ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সোনা-লোভী মানুষ, রাজনৈতিক জটিলতা সব কিছু থেকে ছেলেমেয়েদের আর বোনা এস্পেরোকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। নিজেদের সঞ্চয় ব্যয় করেছেন। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য নিয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন এস্পেরান্তো সংস্থা ও এস্পেরান্তোভাষী বন্ধুদের কাছ থেকে। আপাতত একজন আশি পেরিয়েছেন, অন্যজন আশি ছুঁয়েছেন। কিন্তু দুজনেরই পড়ার কাজ ছাড়া চশমা লাগে না। শরীরও সুস্থ।

বিশাল সবুজ অঞ্চল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা ছয়েক বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সবকটিই বেশ খোলামেলা একতলা বাংলো টাইপ। এই চত্বরে ঢোকা বেরোনোর কোনো গেট নেই। সবই অবারিত। ঢুকেই চোখে পড়ে যে বাড়িটি তার দরজা বেশ চওড়া। সামনে খানিকটা জমি, রাস্তা থেকে উঁচু। সেখানে গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি লম্বা এক দোলনা, একসঙ্গে দশজন বসার মতো। পাশে রয়েছে ছোটো দোলনা, সিস বা ঢেঁইকুচকুচ আর লোহার রড দিয়ে তৈরি বাচ্চাদের বেয়ে ওঠার মাংকি-বারস। দরজা দিয়ে ঢুকে বিশাল হলঘর, দরজার উল্টোদিকে সিমেন্টের বাঁধানো স্টেজ, স্টেজে পিয়ানো, পিয়ানোর মাথায় ও পিছনের জানলাগুলোর গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে সফট টয়, পুতুল-জীবজন্তু সব বসানো। কে ডাকছে, কে কাঁদছে, কে হাসছে, কে চোখ মারছে, কে নাচছে, কে একেবারেই ভোলেভালা, কার ল্যাজটা লম্বা ঝুলে আছে – নানান সব ভঙ্গি। মেঝেতে কিছু টেবিল-চেয়ার। বাঁদিক বরাবর লম্বা চলেছে রান্নাঘর ও ভাঁড়ারঘর। রান্নাঘর ও হলের মাঝের দেওয়াল কেটে কাউন্টার – সেখানে খাবার সাজিয়ে দেওয়া হয়। হলের দিক থেকে প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসে খাওয়া। রান্নাঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটু হেঁটে পাশের বাড়ি – যেখানে আমরা রয়েছি। রান্নাঘর ঝকঝকে, সবরকম যন্ত্রপাতি-বাসককোসন-ওভেন-সিংক-সমৃদ্ধ। হলের ডানপাশে একদিকে বসবার সোফা, অন্যদিকে কম্প্যুটার ও ট্রান্সমিশনের নানান যন্ত্রপাতি। এইসব পেরিয়ে তিনটে ঘর, ক্লাসঘর। সেখানে সাজানো ছবি, বই, খাতা, যত্ন করে ছোলা পেন্সিল, ইরেজার, রংপেন্সিল, পেন্টিং ব্রাশ, ব্যাগ, ব্ল্যাকবোর্ড, বুকশেল্ফ, সারি সারি কম্প্যুটার, নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও টেবিল-চেয়ার। হলে ঢোকার দরজার পাশে একটি বড় ঘন্টা ঝুলছে। সেটার ঢং শব্দ মানে খাবার সময় হয়েছে। এ বাড়িতে কেউ বাস করে না। আমরা যে বাড়িতে আছি সেটি রাস্তা থেকে খানিক উঁচু ও চারিদিকে বারান্দা ঘেরা। বারান্দার নিচে থেকে ঘাসজমি ঢালু হয়ে রাস্তায় এসে মিশেছে। সামনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলে একটা দালান। তার দুপাশে আলমারিতে অনেক বই, ছোটো ছোটো কাঁচের ও পোর্সিলিনের মূর্তি ও পুতুল, নানান উপহার সামগ্রী সাজানো। সব আলমারির পাল্লা নেই। আর থাকলেও তাতে চাবি দেওয়া নেই। আছে জলের মেশিন, কাঁচের গ্লাস, টেবিল-চেয়ার-সোফা, বসে পড়বার জন্যে। দালান ঘিরে চারদিকে চারটে অতিথি-ঘর। কোনো ঘরে দুটি, কোনোটিতে তিনটি, আবার কোনোটিতে চারটি খাট, ধপধপে সাদা বিছানা, আলমারি, টেবিল, আয়না, সিমেন্টের তাক, লাগোয়া বাথরুম। ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা। একটি ঘরে আমি, আরেকটিতে মার্সিয়া, মারিয়ানা ও বেরনার্দো। আপাতত আর কোনো অতিথি নেই। বাড়ির পিছন দিকেও তিনটি অতিথিঘর – তার একটিতে আছেন পোল্যান্ডের আলেকসান্দের, আরেকটিতে জেইসি ও তার নার্স, অন্যটি ফাঁকা। বাড়ির মাঝখানে বড় খোলা উঠোন। আমাদের ঘর থেকে উঠোনে যাবার দরজাগুলো উরসুলা বন্ধ রাখতে বলেছেন। পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলে বাঁদিকে কাপড়কাচার জায়গা। তিনটে ওয়াশিংমেশিন, বড় দুটো সিংক, কল, সাবান, ব্রাশ, বালতি, টাব, ড্রাম ইত্যাদি। ডানদিকে লোহার ফ্রেমে আটকানো কাপড় শুকোনোর তার ও ক্লিপ।

আমাদের বাড়ির সামনে, পুরো একটা আমবাগান পেরিয়ে আরেকটি বাড়ি। সেখানে ছোটোখাটো একটি মিউজিয়াম। সে বাড়িতেও রান্নাঘর, খাবারঘর, কাপড়কাচার জায়গা, বাথরুম সবই আছে জায়গামতো, তবে সেখানেও কেউ থাকেনা। চাবি দেওয়া থাকে। আমাদের বাড়ির বাঁদিকে, খানিক দূরের বাড়িটিতে থাকেন জুসেপ্পে-উরসুলা। তারই একটি ঘরে শের্জো। এই বাড়ির পিছনে জানলা-দরজাহীন একটা বাড়ি - এটি গ্যারেজ। আর আমাদের বাড়ির ডানদিকে সামনে একটা বড় চালাঘরসহ একটা বাড়ি – সেটি ওয়ার্কশপ। তার দেওয়াল ভর্তি যন্ত্রপাতি আর মেঝেতে নানান কিসিমের মেশিন ও পার্টস।

ঘরের বাইরে বেরোলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছোটো ছোটো পোকা, যেগুলো পাকা ফলের চারপাশে ঘুরঘুর করে, সেগুলো ছেঁকে ধরছে, নাকে মুখে ঢুকে যাচ্ছে। বেরনার্দো তো তিতিবিরক্ত। চারিদিকে গাছ। ফলের গাছ, আমগাছে পাকা আম, গাছের তলায় মাটিতে পাকা আমের ছড়াছড়ি, কাঁঠালগাছে ঝুলছে পাকা কাঁঠাল। কালোজাম। গ্রীষ্মের ফল। ফলে আছে শাকসব্জি। ভাবলাম বারান্দার পাঁচিলে বসে লিখি। নিচু চওড়া পাঁচিল। পা-ছড়িয়ে আরাম করে বসা যায়। কিন্তু বসামাত্র একটি সারমেয়, তিনটি মার্জার আর হাজারখানেক পোকা এমন গায়ে লেপ্টে আদর শুরু করল যে লেখা মাথায় উঠল। ইতিমধ্যে এলেন আলেকসান্দের। পোল্যান্ড থেকে এসেছেন, ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, আপাতত এখানে থাকেন। যারা স্বেচ্ছায় শ্রম দিতে চায়, করসেবার মতো, তাদের জন্যে বোনা এস্পেরোর দরজা খোলা। এদের বলা হয় ভোলোন্তুলো, ইচ্ছুক অর্থাৎ শ্রমদানেচ্ছুক। নিজেদের দক্ষতা ও ক্ষমতা অনুযায়ী বোনা এস্পেরোর জন্যে কাজ করা। হতে পারে বাচ্চাদের পড়ানো বা নাচ-গান শেখানো, বা বাগান বা চাষ করা, বা দেওয়াল গাঁথা, বা ইলেক্ট্রিকের লাইন বসানো, বা রান্না করা – যে-কোনো ধরনের কাজ। আলেকসান্দের এখানে ভোলোন্তুলো। কথায় কথায় বললাম যে আমার ক্যামেরা চার্জ করতে পারছি না, ভোল্টেজ ও প্লাগের মাপে সমস্যা হচ্ছে। ক্যামেরা ও তার প্লাগ দেখতে চাইলেন। দেখেশুনে একটা প্লাগ পয়েন্ট দেখিয়ে বললেন এটাতে হবে। সমস্যার সমাধান হলো। ক্যামেরা এখন খাচ্ছে।

অধুনা বোনা এস্পেরোতে কোনো দরিদ্র, অনাথ বা জুভেনাইল কোর্টে শাস্তিপ্রাপ্ত কোনো বাচ্চা থাকে না। জুসেপ্পে-উরসুলার পর আর কেউ এমন সব কিছু ছেড়ে বোনা এস্পেরোর দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেনি। এঁদের এত বয়স হয়ে গেছে যে এক ঝাঁক বাচ্চার সব দায়দায়িত্ব পালনের জন্যে রোজের যে ছুটোছুটির দরকার হয় তা আর পেরে ওঠেন না। প্রয়োজনে একাহাতে সকলের রান্না সামলে নেওয়া, কোনো বাচ্চার শরীর খারাপ হলে রাত জাগা বা মাঝরাতে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আর সম্ভব হয় না। তাই কয়েকটি বাড়ি এখন ব্যবহার হয় না। তবে বোনা এস্পেরো এস্পেরান্তো সেন্টার হিসেবে পুরোদমে কাজ করে। অবশ্য আপাতত বোনা এস্পেরো পুরো ফাঁকা নয়, একটি মেয়ে রয়েছে, নাম জেইসি। সংখ্যায় মাত্র এক হলেও তার গল্প আর কাণ্ডকারখানার তালিকা শুধু লম্বাই নয়, রীতিমত চমকপ্রদও!

জেইসির বয়স বারো, প্রতিবন্ধী – জন্ম থেকেই একটি হাতের তালু-আঙুল নেই। সে মানসিক রোগীও। আমাদের বাড়িরই অন্যদিকটায় থাকে, সঙ্গে তার নার্স থাকে। মাঝে মধ্যেই সে উদ্দাম হয়ে ওঠে, চিৎকার চেঁচামেচি, ভাঙাভাঙি চলে। তবে আজ সে একটু শান্ত রয়েছে। এইসব কারণেই উরসুলা ওই দিকের দরজা বন্ধ রাখতে বলেছেন। জেইসিকে জুভেনাইল কোর্ট থেকে এখানে পাঠিয়েছে দিনদুইতিন রাখতে বলে। কিন্তু ওই দুইতিনটা দেখতে দেখতে আজ ঊনপঞ্চাশ দিনে এসে ঠেকেছে। আমরা এসে অবধি দেখেছি ও আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে ফলের রস আর কেক খেয়ে বেড়াল কোলে নিয়ে চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শান্ত হয়ে বসা বা মন:সংযোগ করতে পারে না। শুনলাম কদিন আগে নিজেই নিজের হাত কেটেছিল, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ছটা সেলায় করিয়ে আনতে হয়েছে। কেন হাত কেটেছিল জিগেস করায় বলেছে যে ও কাউকে একটা মারতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে পায়নি। তাই নিজেকেই মেরেছে। এখানে ও ভয় করে একমাত্র আমান্দাকে। আমান্দা এখানকারই আবাসিক ছিলেন ছোটোবেলায়। এখন বোনা এস্পেরোর দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। শহর থেকে সকালে গাড়ি চালিয়ে চলে আসেন বিকেলে ফিরে যান। উনি কালো নন, চামড়ার রং সাদা। আরও একজন আছেন দেখাশোনার দায়িত্বে, তাঁর নাম শের্জো। শের্জোরও ছেলাবেলা এখানে কেটেছে। শের্জো মাঝে মাঝে রাতে এখানে থাকেন আবার মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে যান। আপাতত টানা এখানেই থাকছেন। কারণ জেইসির কারণে তিনি উরসুলা-জুসেপ্পের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। শের্জো উরসুলা-জুসেপ্পেকে কিছুদিন শহরে গিয়ে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু ওঁরা রাজি না হওয়ায় উনিই এখানে থাকছেন। জেইসি আমান্দাকে ভয় করে। কারণ ও আমান্দাকে খুন করবে বলেছিল। উত্তরে আমান্দা বলেছে - তার আগেই আমি তোমাকে খুন করব। অতএব ও আমান্দাকে সমঝে চলে। জেইসি মাঝে মাঝে উরসুলার কাছে ঘোষণা করে বলে যে সে আজই আত্মহত্যা করবে। উরসুলা শান্তভাবেই তাকে বুঝিয়ে বলেন – ঠিক আছে, ভালো কথা। তবে আজ নয়, কাল কোরো, প্লিজ। এইভাবে রসেবশে ভালোবাসায় দিন কাটে।

এখানে আছেন আরেক মহিলা, দোনা মারিয়া – মারিয়া নাম, দোনা হলো পর্তুজীজ ভাষায় সম্বোধন, যেমন আমাদের বাংলায় দিদি, বা হিন্দিতে জী। মারিয়া বয়স্ক, তার এখানে অবস্থানও কোর্টের অর্ডার অনুসারে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এখানে। তার অপরাধ কী ছিল তা আমার জানা নেই। মারিয়া এখানে ঘরদোর, বাসনপত্র সবকিছু পরিস্কার রাখে, রান্নায় সাহায্য করে, দরকার হলে রান্নাও করে। মারিয়া এখানে আনন্দে থাকে আর তাকে নিয়ে এঁরাও আনন্দেই থাকেন।

সন্ধ্যে সাতটায় নৈশভোজ। খাবারদাবার সব নিরামিষ। আনাজপাতি ফলমূল সবই এখানকার উৎপাদন। আজকের মেনুতে বেগুন ও অন্যান্য সবজি দিয়ে তৈরি ম্যাকারনি, শসা ও বিটের স্যালাড আর শেষ পাতে তরমুজ। খাওয়ার পর প্রচুর আড্ডা হলো। জেইসির জন্যে আজ একজন নতুন নার্স এসেছে। আইন মোতাবেক কোথাও থেকে পাঠায়। নার্স মেয়েটির আজ বাইশ বছরের জন্মদিন। সেও খাওয়া সারলো আমাদের সঙ্গে। বলল যে সেও ছেলেবেলায় এই বোনা এস্পেরোতে থাকত, উরসুলার কাছে ঘুমোতো। উরসুলা অবশ্য মনে করতে পারলেন না। অসম্ভব নয়, আটশো বাচ্চাকে বড় করেছেন উরসুলা! সব শেষে সবাই মিলে গান গেয়ে আর হাততালি দিয়ে জেইসিকে ওষুধ খাওয়ানো হলো। এবার শোওয়ার তোড়জোড়। চারিদিক নি:শব্দ – শুধু পোকার আওয়াজ আর ব্যাঙের ডাকের কনসার্ট! এ কনসার্ট চলবে সারারাত! দিনের বেলার সেই অজস্র ফলের পোকা সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়েছে।

একদিন একরাত কেটে গেছে। প্রাতরাশ সেরে, সঙ্গে আনা উপহারাদির পর্ব শেষ করে শের্জো, মার্সিয়া আর আমি ঘুরতে বেরোলাম। সঙ্গে অবশ্যই সেই সারমেয়, নাম লেওনো, মানে লায়ন, সিংহ। বোনা এস্পেরোর মোট সাতশো হেক্টর জমি। তবে চাষবাস বা ফল ফলানো হয মোটে তিরিশ হেক্টরে। আগেই বলেছি যে এই চত্বরে গোটা ছয়েক বাড়ি আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, নেহাৎই গৌণভাবে। মুখ্য হলো পাহাড় ঘেরা সবুজ প্রকৃতি। এখন ব্যবহার না হলেও প্রতিটা বাড়িই গোছানো – কোনোটাতে বাচ্চাদের থাকার ঘর – কোনোটাতে অতিথিদের, চওড়া বারান্দা, প্রশস্ত রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর ও খাবার ঘর, কাপড়কাচা ও মেলার জায়গা ও ব্যবস্থা, যত্নে ফোটানো ফুলের বাহার, আর তাকে ঘিরে প্রকৃতির সবুজের সম্ভার – ফলের গাছ, বিশাল ইউক্যালিপটাস আরও কত চেনা-অচেনা বৃক্ষ। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু এগিয়ে একটি লেক, স্বচ্ছ টলটলে জল, দেখলেই সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। এটি প্রাকৃতিক নয়, কেটে তৈরি করা। একপাশে পাম্প-পাইপ লাগানো, জল সরবরাহের জন্যে। পথে একপাশে কুলগাছের মতো একটি গাছ ছোট্টো ছোট্টো টমেটোর মতো ফলে ভর্তি। মাটিতেও ছড়িয়ে অজস্র। পাকাফলের রং টুকটুকে লাল। ওদেশের ফল। খেলাম, খুব মিষ্টি। পথের অন্যপাশে লম্বা লম্বা সরু সুঁচোলো পাতার ঝাড়। সেই ঝাড়ের একটি পাতার গায়ে যেন একটা বিশাল সাদা অ্যাঞ্জেল মাছ লাগানো। কৌতুহলে মুখ বাড়িয়ে দেখতে যাচ্ছিলাম। শের্জো বাধা দিয়ে বললেন ওটা অত্যন্ত বিষাক্ত পোকার বাসা, সরে এসো। পথে অজস্র আমগাছ, গাছেও যত ফল মাটিতেও তত ফল পড়ে শুকোচ্ছে, পচছে। বাড়িগুলোকে যদি বসতি বলি তো তাহলে সেই বসতির এক সীমানায় এই লেক আর অন্য সীমানায়, বাড়ির পিছন দিক থেকে শুরু চাষের ক্ষেত, যতদূর চোখ যায় তার বিস্তৃতি। তারই মাঝে এক জায়গায় ডক্টর লুদোভিক জামেনহফের একটি হাফবাস্ট মূর্তি। ইনিই হলেন এস্পেরান্তো ভাষার নির্মাতা, যে এস্পেরান্তোকে কেন্দ্র করে এত সব কাণ্ডকারখানা। বসতির সীমানার মধ্যেই আছে একটি চারকোনা লম্বা স্তম্ভ, তার মাথায় একটি তারা। এস্পেরান্তোর প্রতীক হলো সবুজ তারা। স্তম্ভটি অনেকটা উঁচু হলেও তার গায়ে লোহার শিক গেঁথে গেঁথে পা রাখার জায়গা করা আছে, তাতে পা রেখে রেখে বাচ্চারা বা যে কেউ ওপরের তারাটায় চড়ে স্বস্তিতে বসতে পারে। স্তম্ভের সামনে ও পিছনে এসপেরান্তোতে লেখা “কে লা পাৎসো রেগু লা মোন্দো” পৃথিবীতে শান্তি কর্তৃত্ব/বিরাজ করুক। স্তম্ভটি আমার কাছে প্রতীকী। কত শিশু যে এস্পেরান্তোর হাত ধরে তাদের হেলাফেলা যাপন পেরিয়ে নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করে আপন পারিবারিক স্বস্তির মুখ দেখেছে!

বসতি এলাকার মধ্যেই রয়েছে সবজি বাগান। উরসুলা নিজে বিভিন্ন সবজির বেড তৈরি করান, নিজের হাতে জল দেন ও পরিচর্যা করেন। এখন ফলে রয়েছে নানান রঙের বড় বড় পুরুষ্টু ক্যাপসিকাম, মানে বেল পেপারস, কচি কচি লাউ, বেগুন, অজস্র কুমড়োফুল ইত্যাদি। আশপাশে রয়েছে গোটা পাঁচেক কাঁঠালগাছ, গোড়া থেকে মাঝ অবধি জিভে জল আনা রসালো কাঁঠালসারির প্রদর্শনী সাজিয়ে।

আজ দুপুরের মেনুতে রয়েছে ভাত, অবশ্যই চাল অন্য ধরনের, ক্যাপসিকামের তরকারি, সোয়াবিনের কিমা, রাজমা ধরনের কোনো বিনের তরকারি, কপিপাতার স্যালাড, বাঁধাকপি ও টমেটোর স্যালাড, কোনো শাক মিক্সিতে বেটে, তাতে নানারকম মশলা ও অলিভ অয়েল সহযোগে তৈরি যেটা সেটাকে নাহয় চাটনিই বলি, আর শেষ পাতে তরমুজ। খাওয়ার পরে খাওয়ার কালচার নিয়ে আড্ডা চলল খানিকক্ষণ। ইউরোপে বাঁ-হাতে কাঁটা ধরে আর ডান-হাতে ছুরি। ব্রাজিলে ঠিক উল্টো। আমি বললাম যে আমরা ডান হাত দিয়ে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই খাই। কথা হলো রাতে ডান হাতে খাওয়ার ডেমো দেবো।

এবার গল্পের বিষয়বস্তু বোমবোম। সেই বারো বছরের মানসিক ভারসাম্যহীন জেইসি। মাঝেমধ্যেই সে বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটায় বলে উরসুলা ওকে বোমবোম বলে উল্লেখ করেন। জেইসির বাড়িঘরদোর-মা-বাবা সবই আছে। কিন্তু সে রাস্তায় ঘুরতো, লোকের কাছে ভিক্ষে করত, রাস্তাতেই থাকত। লোকে দু-এক রিয়েল (ব্রাজিলের টাকা, তখন মোটামুটি এক রিয়েল মানে ভারতীয় 22/23 টাকা) দিতও। একবার ওরই মতো কোনো ফুটপাতবাসী ওকে একসঙ্গে পাঁচ রিয়েল দেয়। বেশি পেয়ে ওর রিয়েল জোগাড়ের খাটুনি কমে। তাই ও আবার তার কাছে গিয়ে রিয়েল চায়। কিন্তু সেবার সে না দিয়ে ভাগিয়ে দেয়। রিয়েল না পেয়ে জেইসি ক্রুদ্ধ। তাই মাঝরাতে পাথর ছুঁড়ে ও সেই ফুটপাতবাসীটিকে খুন করে। এরপর দেড়বছর জেল। তারপর কোর্টের অর্ডারে জেইসি এই বোনা এস্পেরোতে।

জেইসি এখানে স্বাধীনভাবে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ায়। খাবার সময়ে এসে খাবার নিয়ে খায়। অন্য সময়েও যা দরকার তা নিয়ে যায়। এখানে সব দরজাই সবার জন্যে সব সময়েই খোলা। উরসুলার মতে – ও জানে এখানে ওর খাবার ভাবনা নেই। কেউ গায়ে হাতও তুলবে না। ও কয়েকবার পালিয়েছে, বলা ভালো যে পালাবার ভান করেছে। তবে ও তো রাস্তায় বেঁচে থাকার কষ্টটা জানে, তাই হয়তো সত্যি সত্যি পালাবে না। পালানোর ভান করে ভয়ই দেখাবে।

ডায়রি লিখতে লিখতে খেয়াল করিনি যে কখন ঘণ্টা বেজেছে আর সবাই 3.15-র লুঞ্চো (বিকেলের জলখাবার) খাওয়া সেরে ঝর্ণা দেখতে যাবার জন্যে তৈরি। মার্সিয়া ডাকতে এল। খিদেও পেয়েছে, রোদও যথেষ্ট কড়া। না খেয়ে বেরোলে মাথা ধরে যাবে। খুবই লজ্জিত হয়ে ছুটলাম খাবার জায়গায়। উরসুলা খেয়ে নিতে বললেন। দোনা মারিয়া ধোসা ধরনের কিছু একটা তৈরি করে দিল। সঙ্গে কেক আর পুদিনা ইত্যাদি মেশানো একটা পানীয়। তাড়াতাড়ি, গোগ্রাসে! তাড়া অবশ্য কেউ দেয়নি আমায়।

মার্সিয়া, আলেকসান্দের, শের্জো, জেইসি, আমি আর যুধিষ্ঠিরের সারমেয় লেওনো। এই হলো ঝর্ণা যাত্রীর দল। যেতে-আসতে চার কিলোমিটার পথ। জেইসি আগে, লেওনো সোজা পথ ধরে যায় না – দুপাশের ঝোপঝাড়ই তার পছন্দের পথ। তার চলার ছন্দও বিচিত্র – লাফিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, ছুটে, থমকে থেমে! তবে ওর চলা থেকে যেমন আনন্দ উছলে উঠছিল ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল যে রাস্তাটিও নিরাপদ – সাপখোপশূন্য। তিন মহাদেশের চারটি মানুষ গল্প করতে করতে চলেছে। মাথার ওপর আকাশ দুরন্ত নীল, মেঘের গ্রে-স্কেল পুরো দৃশ্যমান। দূরে বালেনো পাহাড় (এস্পেরান্তোতে তিমি, পাহাড়ের আকৃতিটা তিমি মাছের মতো), স্পষ্ট সীমারেখায় আঁকা। মাথার ওপর ঝকঝকে সূর্য। আবার ওধারে আধখানা চাঁদও রয়েছে আকাশে। গায়ে, পায়ে প্রচুর ক্রিম মাখা হয়েছে মশা ও পোকা তাড়ানোর জন্যে। ছোটো ছোটো প্রচুর পোকা গায়ে একেবারে ছেঁকে ধরে। পথে অজস্র কৃস্টাল পড়ে রয়েছে। এই পাহাড়ের অন্যতম বিশেষত্ব এই যে এখানে পাথরের অনেকটা অংশই কৃস্টাল। এই কৃস্টালের ওপর দিয়ে বয়ে আসা জল স্বচ্ছ, স্বাদু ও পানযোগ্য।

ঝর্ণার আওয়াজ কানে আসতেই জেইসি তো ছুট লাগালো। আর আমরা পৌঁছে দেখি সে জুতো-মোজা খুলে রেখে জিনস-টিশার্ট পরেই জলে ঝপাং – সাঁতরাচ্ছে। পরিস্কার টলটলে জল – একদিক থেকে ধারা আসছে, বড়সড় ডোবার মতো একটু গভীরে জমছে – আবার তা উপছে বিপরীত দিকে অন্য ধারায় বয়ে যাচ্ছে। জল যেখানে জমছে তার নিচের কালো-হলুদ পাথর, ছোটো ছোটো কমলা রঙের মাছ, সবুজ গুল্ম, সবটুকুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জেইসি মনের আনন্দে সাঁতরাচ্ছে, ডাকছে। আমার ইচ্ছেটাও টগবগ করছে। মার্সিয়াকে জিগেস করলুম – নামবো? ও বলল – আগু লাউভোলে, তোমার যা ইচ্ছে। চট করে ভেবে নিলাম সালোয়ার-কামিজ পাতলা সুতির, রোদ যা কড়া ফিরতি পথেই শুকিয়ে যাবে, এই ঝর্ণার সঙ্গে আর তো জীবনে দেখা হবে না! চশমাটা মার্সিয়ার হাতে ধরিয়ে, চটি খুলে নেমে পড়লাম। আ:! জল কী ঠাণ্ডা। কী আরাম! সাঁতার কাটার মতো প্রশস্ত। কোনো মালিন্য বা শেওলা নেই জলে। এ কেমন অন্য যাপন! ছবি উঠলো অনেক।

জল থেকে উঠে ভিজে জামার ওপর শুকনো ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়ে ফেরা। মার্সিয়া দুশ্চিন্তা করছিল ফিরতে ফিরতে যদি সূর্য ডুবে যায়। আমাদের দুজনেরই পায়ে চটি, পা-ঢাকা জুতো নয়। আন্ধকারে ঝোপের মধ্যে দিয়ে চটি পায়ে হাঁটা নিরাপদ নয়। ফিরতে ফিরতে জামা-কাপড় অর্ধেক শুকিয়ে গেল। প্রথমেই খাবার ঘরে ঢুকে বড় এক কাপ ব্ল্যাক কফি, তারপর ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় কেচে নিয়ে স্নান, তারপর আবার এসে বসেছি ডিনারের ঘণ্টায় সাড়া দিয়ে।

দিন দশেক আগে জেইসি নিজের হাত কেটেছিল তা আগেই বলেছি। ওর প্ল্যান ছিল বুড়োবুড়িকে, জুসেপ্পে-উরসুলাকে, খুন করে। সেই মতো একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে অস্ত্রও তৈরি করেছিল। কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে সে নিজেই নিজের হাতই কাটে। শের্জো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে তার মুখ থেকে এসব কথা জেনে ফোন করে উরসুলাকে বলেন তখনকার মতো বোনা এস্পেরো ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকতে। ওঁরা তাতে রাজি হননি। অগত্যা তারপর থেকে ওঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শের্জো নিজেই রাতে বোনা এস্পেরোতে থাকতে শুরু করেন। তবে এইসব কাণ্ডের জেরে বোনা এস্পেরোর রাঁধুনি তার নয় আর এগারো বছরের দুটো বাচ্ছাকে নিয়ে ভয়ের চোটে কাজ ছেড়ে চলে যায়। ফলে এখন দোনা মারিয়াই একমাত্র সাহায্যকারী, তাকে রান্নাও সামলাতে হচ্ছে।

উরসুলাদের বাড়িতে একটা ছোট্টো লাইব্রেরি আছে। আজ প্রাতরাশের পরে মার্সিয়া, উরসুলা ও আমি সেখানে বসে আলোচনা করছিলাম। ধর্ম নিয়ে আমার আর মার্সিয়ার ভাবনা-চিন্তার মধ্যে কোনো মিল নেই। ওর আধ্যাত্মিক পৃথিবী আমি চিনি না, ওর কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, সাঁইবাবা ও অজস্র ভারতীয় বাবারা আমাকে আবেদন করে না। ও অনেক কিছু অলৌকিক দেখতে ও শুনতে পায়। আমি ওই অলৌকিকত্ব ভালো বুঝি না। আগে উড়িয়েই দিতাম। এখন সেটা ততটা জোরের সঙ্গে পারি না। এখানে দেখেছি এই আধ্যাত্মিক জগৎ, মৃত্যুপরবর্তী জীবন, পরলোক শুধু ওর জীবনেই নয় অনেকের জীবনেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্সিয়া বিভিন্ন ধর্মের হাত ধরে সেখানে পৌঁছতে চায়, বুঝতে চায়। ভারতে ধর্মেরও অভাব নেই, গুরুর তো নয়ই। তাই ভারত এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে ওর জীবনে। তার ওপর আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁকে সারা বিশ্ব চেনে একজন সাধক কবি হিসেবে। মার্সিয়ার অলৌকিকের অংশ সে নিজের চোখে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছে এবং যখন দেখেছে তখন ও তাঁর নামও শোনেনি! মার্সিয়ার অলৌকিক দেখা ও শোনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওর পরিচিত অনেকে নানান কথা বলে। অবিশ্বাসের কথাই মূলত। মার্সিয়া নিজে নিউরোলজিস্টের কাছে গেছে। ওর নিজেরও তো ডাক্তারি ও শারীরবিদ্যার অনেকটাই রপ্ত। নিউরোলজিস্টকে নিজের অদ্ভুত রকম দর্শন ও শ্রবণের বর্ণনা দিয়ে তাঁকে জিগেস করেছে – আমি কি অস্বাভাবিক? তিনি বলেছে – না, কারো কারো ইন্দ্রিয় শক্তির তীক্ষ্ণতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তাদের এই রকম বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়। মার্সিয়ারও তাই। সে অস্বাভাবিক নয়, তবে সর্বসাধারণের মতোও নয়।

উরসুলা ধর্মে বিশ্বাস করেন না, কারণ ধর্ম তো মানুষের তৈরি। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে তিনি নিজেই নিজের এক ধরনের দায়বদ্ধতা গড়ে তুলেছেন। তিনি যে বাচ্চাদের পড়িয়েছেন, বড়ো করেছেন তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত তো কখনোই করেন নি, উপরন্তু চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধেও তাদের জানাতে। যাতে তারা জানতে পারে কী কী আছে বা কী কী পাওয়া যায়। এরপরে ভাল-মন্দ ও নিজের প্রয়োজন বুঝে কোনটা বাছবে বা কোনটা ছাড়বে বা সবকিছুই ছাড়বে কিনা তা সেই ঠিক করবে। এইভাবে উরসুলা ধর্মের একটা মুক্তাঞ্চল নির্মাণ করেন এবং সেই মুক্তাঞ্চলের নিরপেক্ষ বাতাসের পুষ্টিতে বাচ্চাদের মন যাতে অন্য ধর্ম ও ধর্মীয়কেও শ্রদ্ধা করতে শেখে সেটার যত্ন নেন। কিন্তু উরসুলা নিজে আদৌ ধর্মবিশ্বাসী নন। ওঁর মতে ‘এস্তি এতিকে কোরেক্তা’বা এথিকালি করেক্ট থাকা বা নিজের কাছে নিজে সৎ থেকে বৃ্হত্তর মানবসমাজের একজন হয়ে ওঠার ভাবনাটাই প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট। এসব কথা বুঝতে আমার সময় লাগে না। আলোচনা চলতে থাকে। আর আমার মনে হয় আমার মনের ভাবনাগুলোই যেন অন্যের মুখের ভাষায় প্রাণ পাচ্ছে, স্পষ্টতা পাচ্ছে। উরসুলা নাস্তিক নন এবং এ ব্যপারে ওঁর যুক্তিটা তুখোড়। অ্যাথেয়িস্ট বা নাস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, বিরোধিতা করে। উরসুলার প্রশ্ন – তোমরা যেটাকে নেই বলো সেটারই বিরোধিতা করো কী করে? কোন যুক্তিতে? বিরোধিতা তো তারই করা যায় যা আছে। উরসুলার আস্তিকতায় যুক্তির আধিক্য, ভক্তির নয়। আর সেই আস্তিকতার কেন্দ্র ঈশ্বর ওঁর কাছে একটা বিশাল ব্যাপার। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় বা প্রয়োজন কোথায় তার! আমরা যা শুনি তা তো নানান এনার্জির প্রতিফলন। কত রকম এনার্জির ঢেউ উঠছে পড়ছে এই গ্রহে, গ্রহপুঞ্জের এই বিশ্বে। তারই টুকিটাকি আমাদের করো কারো কাছে পৌঁছয়।

আমার মনে হলো হয়ত সেই রকমই এনার্জি ছিল রবীন্দ্রনাথের। আমরা ওঁকে জানি লেখক-কবি-সঙ্গীতকার-দার্শনিক-এডুকেশনিস্ট হিসেবে। বাইরের পৃথিবী ওঁকে চেনে মূলত আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে। ওঁর অন্যান্য কাজকর্ম এই এনার্জির প্রতিফলন, কোনো এনার্জিই ওঁকে দিয়ে করিয়েছে এসব। হয়তো বা!

বুঁদ হয়ে আচারিক ধর্ম পালন সম্বন্ধেও উরসুলার খুব যুক্তিসঙ্গত মতামত আছে। বোনা এস্পেরো চায় কোনো পরিবার বা গোষ্ঠী এখানে আসুক, এই জমিতে বসবাস শুরু করুক, চাষবাস করুক, স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করুক। তাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় সহায়তা বোনা এস্পেরো দেবে। বললেন, একবার এক ধর্মীয় গোষ্ঠী এসে আমাদের জমিতে বাস করতে শুরু করল এই ভাবেই। কিন্তু এতই অবাস্তব তাদের দৈনন্দিনের যাপন ও ভাবনা যে তারা ফসল ফলানো তো দূরের কথা, যে-কটা ফলের গাছ ছিল সেগুলিরও দেখভাল না করে নষ্ট করে ফেলল, তারপর আবার সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেল। ধর্মের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মুখটাকে বরদাস্ত করা তো আরেকটি অন্যায়েরই নামান্তর!

আলোচনা চলতে থাকে। আর তাতে যোগ দিতে দিতে আমি যেন নিজেকে, আমার চারপাশের সমাজকে, আর আমার দেশকে একটু একটু বুঝতে পারি। ধর্মাচরণ নিয়ে আমার মতামত আমার আশপাশের সঙ্গে মেলে না। আমার চারপাশে তো ধর্মের বন্যা। কিন্তু সে যেন শুধুই প্রশ্নহীন অভ্যাস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধর্মাচরণ করে, করতে হয় বলে। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক নেহাৎই দেওয়া-নেওয়ার। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাপের ভয় আর পুণ্যের লোভ! এর কোন শব্দটা সদর্থক? যে ধর্মাচরণ করে সে ধর্মভীরু! শেষ অবধি ভীরু! সব ধর্মই তো মানবিকতার উত্তরণের কথাই বলে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সব ধর্মেই আমরা-ওরা-বিভাজনের সূত্র ধরে লড়িয়ে দেবার জন্যে প্রয়োজনীয় মশলা-বারুদের উপকরণ থেকেই যায়। ধর্মের ধুয়ো তুলে যুদ্ধ ও ধ্বংসের তাণ্ডব তো সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি অব্যাহত। থামবার কোনো আশু সম্ভাবনা নেই। থামাবার মতো কোনো শক্তি নেই। আমার দেশ বহুধর্মের দেশ। বহু ধর্মের সহাবস্থান। কিন্তু আজও তো বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সহজ বোঝাপড়ার লেনদেনের কোনো আমদরবার তৈরি হয় নি এ জমিতে। যে যার খোপে বাস করে। তার বাইরে যেতে শেখায় না তার ধর্ম। তাই এই সহাবস্থানের অপরিহার্য্য অঙ্গ, বলা বাহুল্য, শান্তি নয়, বরং অবিশ্বাস। দূরের পৃথিবী যখন দেখে ভারতে নানা ধর্মের সহাবস্থান, তখন আমরা ভারতীয়রা দেখি ধর্মের নানান মুখ – যার অধিকাংশই ফন্দিবাজ ও সহিংস।

উরসুলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার নিজের ভিতরের নানান দ্বন্দ্ব, পছন্দ-অপছন্দ অনেক স্পষ্ট চেহারা নিল। অনেক না-করা প্রশ্নের উত্তর মিলল। হয়তো মার্সিয়াও আমাকে আরো একটু বুঝল। আড্ডা শেষে বারবার মনে হলো আমার এখানে আসার প্রয়োজন ছিল।

আজও বিকেলের লুঞ্চোর পরে ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার কথা। এ অন্য ঝর্ণা, আরও বড়। কালকের মতোই দূরে। যেতে-আসতে হাঁটতে হবে পাক্কা দুঘণ্টা। কিন্তু বেরোতে দেরি হচ্ছে। নিকাশি পাইপে গাছের শেকড় ঢুকে একটা বাথরুম অকেজো হয়ে গেছে। সেটা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে – শের্জো সেখানে ব্যস্ত। শেষ অবধি মার্সিয়া, আলেকসান্দের ও আমি, তিনজনে যাত্রা শুরু করলাম। কালকের মতোই ঝকঝকে কটকটে রোদ, সঙ্গে পোকা! প্রথমে বেশ হাওয়া ছিল, তাই পোকা কম। পরে ক্রমশ পোকা বেশি হাওয়া কম। যেতে যেতে একটা পয়েন্টের পর আর পায়ে-চলা পথও নেই। আলেকসান্দের সে কথা উল্লেখ করলেন। আমি ভাবছি ফেরার সময় পথ খুঁজে পাওয়া যাবে তো! তবে আলেকসান্দের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। ভাষায় সেটা প্রকাশ না পেলেও ফিরতি পথে বুঝতে পারলাম ওঁর পথ সম্বন্ধীয় ওরিয়েন্টেশন কতটা ঠিকঠাক। এক পাও ভুল হাঁটতে হয় নি।

পাহাড়ি নদী, পাথরে ওপর দিয়ে উঁচু-নিচু তল পেরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে ঝপাং করে অনেকটা নিচে লাফ দিয়েছে, এক্কেবারে গা ঘেঁসে। স্বচ্ছ জল। অনেক নিচের নদীর তলার পাথরের রঙটাও স্পষ্ট দেখা যায়। এসব নাচানাচি সেরে নদী বা ঝর্ণা, যে নামেই ডাকি না কেন, সে গাছপালার ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেমালুম লুকিয়ে পড়েছে।

ঝর্ণা থেকে ফিরে জল ও কফি খেয়ে রান্নাঘর ঢুকে ক্যাপসিকাম কাটলাম। স্যালাড হবে। কোলকাতা থেকে পাঁপড় এনেছিলাম। সেঁকলাম। তারপর ডিনার সাতটায়। অদ্যই শেষ রজনী। সকালে উরসুলা বোনা এস্পেরো লেখা একটা সবুজ টি-শার্ট দিয়েছেন। কাল সেটা পরেই ফিরবো।

বোনা এস্পেরো থেকে ব্রাসিলিয়া হয়ে রিও। ফিরতি পথে এবার বাস নয়, গাড়ি। সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্টের পরে শের্জো গাড়িতে করে নিয়ে যাবেন আলতো পারাইসো। সেখান থেকে অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে যাতে করে আমরা সোজা চলে যাবো ব্রাসিলিয়ার এয়ারপোর্টে। সকলকে আলিঙ্গন করে, গালে গাল ঠেকিয়ে বিদায় নিয়ে বেরোনো হলো। আলেকসান্দের মজা করে হাতের তালুতে অদৃশ্য চোখেরজল ফেলতে লাগলেন। স্বর্গ থেকে বিদায়! নটায় আলতো পারাইসো। প্রায় বারোটায় এয়ারপোর্ট। যে যুবকটির গাড়িতে এলাম শুনলাম যে তারও ছেলেবেলা কেটেছে বোনা এস্পেরোতে। উড়ান দুটো চল্লিশে। ম্যাকডোলাল্ডে আইসক্রিম খেয়ে বিমানে উঠলাম। চারটের পরে বিমানের চাকা রিওর মাটি ছুঁলো। তারপর যথারীতি ব্যাগেজ সংগ্রহ, ট্যাক্সি নেওয়া ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় বাড়ি। মার্সিয়ার বাড়ি।

রাতে বেরনার্দোর আবদার ছিল পিৎসা খাবার। অর্ডার করা হলো পিৎসার, সঙ্গে গুয়ারানি – ব্রাজিলের নিজস্ব এক ফলের রস। গুয়ারানির গ্লাস হাতে শুরু হলো দ্বিতীয় পর্বের ব্রাজিলিয়ানার। বোনা এস্পেরো ভৌগোলিকভাবে ব্রাজিলে হলেও ওটা তো ঠিক ব্রাজিলিয় নয়। বোনা এস্পেরো হলো বোনা এস্পেরো! উত্তমাশা! ভালোবাসা!

এবার রিও তথা ব্রাজিল

ফেব্রুয়ারির এক তারিখ আজ। পাঁচ অবধি থাকব রিওতে, মার্সিয়ার বাড়িতেই। সকালে উঠে অবধি দেখছি শহর দখল করে নিয়েছে বৃষ্টি। অতএব বাড়িতে বসে গল্পের আয়োজন। মারিয়ানা-বেরনার্দো ছাড়াও মার্সিয়ার আরো এক মেয়ে আছে, সেই বড়। সে তার আঠেরো বছরের জন্মদিনের রাতেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, কারণ সে সেই মুহূর্ত থেকে আইনত সাবালোক, অর্থাৎ স্বাধীন। অতএব তার মায়ের শাসনে বা অধীনে থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। সে থাকে তার এক মাসির পরিবারের সঙ্গে। এ দেশে বাচ্চাদের খরচ চালায় রাষ্ট্র। বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হলেই তার জন্যে নির্দিষ্ট সরকারি মাসোহারা তার বাবা বা মায়ের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। আর পড়াশুনোর খরচ তো পুরোপুরি রাষ্ট্রেরই। অতএব আর্থিক দিক থেকে বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরতাটা অনেক কম। তবে এই রাষ্ট্র-নির্ভরতারও আবার ভালো-খারাপ নানান দিক। এখানকার জনজাতিদের অসীম রাষ্ট্রীয় সাহায্য, আমাদের চেনা শব্দে যাকে বলে ভর্তুকি। বাচ্চা বড়ো করার মাসোহারাও আছে তার মধ্যে। ফলে এই জনজাতির মানুষজন তাদের বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে সেই মাসোহারাটা নিশ্চিত করে, কিন্তু লেখাপড়া হলো কিনা তা নিয়ে মাথাই ঘামায় না। ভর্তুকিপুষ্ট জনজাতিরা পরিশ্রম করে না, নেশাভাঙ করে। দেশের অর্থনীতি গড়ে তোলাতে তাদের অবদান শূন্য হলেও ভেঙে ফেলাতে তাদের অবদান অপরিসীম। যাঁরা রাষ্ট্রকে কর দেন তাঁরা স্বভাবতই ভর্তুকি-বিরোধী। তাঁরাও আমাদেরই মতো বিশ্বাস করেন যে দান-খয়রাতি-ভর্তুকির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বা মানবসম্পদের উন্নতি করা যায় না। তবে আমাদের সঙ্গে একটা পার্থক্য হলো যে আমাদের দেশের জনগণ তো এতটা রাষ্ট্রনির্ভর নয়। ব্যক্তিগত স্তরে রাষ্ট্র জনগণকে প্রায় কোনো সহায়তাই দেয় না। রিজার্ভেশন পলিসির সুযোগ যারা নিতে পারে আর সিনিয়র সিটিজেনদের টিকিটের দামে, ব্যাংকের সুদে ও করে কিছু ছাড় – এটুকু ছাড়া! কিন্তু সে ভর্তুকিও তো সমাজের নিম্নতম স্তর অবধি পৌঁছোয় না। রিজার্ভেশন পলিসির আওতায় যারা পড়ে তাদের অনেকেই নিজেদের প্রাপ্য সম্বন্ধে সচেতন নয়। আর ট্রেনে বা বিমানে ভ্রমণ, ব্যাংকে টাকা রাখা বা কর দেওয়ার সীমানার বাইরে দেশ জুড়ে যে অসংখ্য বয়স্ক মানুষ তাদের অবস্থান রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যের সীমার বাইরেই। ফলত আপামর জনসাধারণের লড়ে বাঁচার অভ্যেসটাই গড়ে ওঠে। উপরন্তু রাষ্ট্র-দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশাও তৈরি হয় না। আর তাই পশ্চিমী অর্থনীতিতে বার বার ধ্বস নামলেও আমরা টিম টিম করে টিঁকেই থাকি। আমার রাষ্ট্র করদাতাদের চেনে ততদিন যতদিন তারা কর দেয়। তার আগে বা পরে নয়। আর যতদিন চেনে ততদিন তাকে করদাতা হিসেবে যত না চেনে তার চেয়েও বেশি চেনে কর ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে। করদাতা হিসেবে আলাদা স্বীকৃতি নেই, কিন্তু পাছে কর ফাঁকি দেয় তাই নজরদারী আছে।

মার্সিয়া পরিশ্রমী। যৌবনে পার্টি-সিগারেট-অ্যালকোহলের সঙ্গে ভালোই পরিচিতি থাকলেও আস্তে আস্তে ও সব কিছু ছেড়ে দিয়ে খুব সহজ সরল দৈনন্দিন জীবন বেছে নিয়েছে। আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসীও। নিরামিশাষী। ছেলে-মেয়েরা আমিষ খায় বাইরে বা বাইরে থেকে এনে। বাড়িতে তৈরি হয় না। বড়ো মেয়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের মূল কারণ তার বয়ফ্রেন্ড ব্যাপারে মনোভাব। মার্সিয়ার মতে বয়ফ্রেন্ড পছন্দ করার মতো ম্যাচিওরিটি মেয়ের এখনও আসেনি, ওর পড়াশোনাটা আরও একটু বাড়ানো দরকার, আরো কয়েক বছর ধৈর্য ধরা দরকার। আর মেয়ের মনে হয়েছে মায়ের জন্যে তার পৃথিবীর সব সুখ এখুনি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই টানাপোড়েন তো আমাদেরও চেনা। মার্সিয়ার সংসারে কোনো কাজেরলোক নেই। কাজেরলোক রাখতে গেলে তার অনেক আইনি বাঁধন – মিনিমাম ওয়েজ, সুযোগসুবিধে, মানবাধিকার ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা আইনের অপব্যবহারের। আইনের অপব্যবহার করে মধ্যবিত্ত পরিবারকে চূড়ান্ত হেনস্থা করার কারণে সাধারণ মানুষ কাজেরলোক রাখার কথা ভাবতেই পারে না। মারিয়ানা-বেরনার্দো আর মার্সিয়া তিনজনে মিলেই সংসারের কাজকর্ম করে। মারিয়ানা রান্না করে, ঘর পরিস্কার করে। বেরনার্দো আছে মেশিনে জামাকাপড় কাচার ও বাসন মাজার দায়িত্বে। মার্সিয়া বাজার-ভাঁড়ার, সব রকম বাড়তি প্রয়োজন ও দেখভালের দায়িত্বে। আমরা কিন্তু ভাবতে পারি না তেরো বছরের মেয়েকে রান্নার দায়িত্ব দেওয়ার কথা। সে তো তখনও আদর খায়। মার্সিয়ার বক্তব্য ও নিজে ছোটোবেলা থেকেই বাড়ির সমস্ত কাজ – রান্না, প্রত্যেকের জামাকাপড় ইস্ত্রি করা ও বাড়ির সব নর্দমা পরিস্কার রাখা – এই সব করেই পড়াশুনো এমনকি ডাক্তারিও পড়েছে, তাহলে এরাই বা পারবে না কেন? মার্সিয়ার বাবা-মা দোকান সামলাতেন। ওরাও পাঁচ ভাইবোন ছিল। তাছাড়া মারিয়ানা বা বেরনার্দোর দিনে দুঘন্টা করে লাগে বাড়ির কাজ সারার জন্যে। মাত্র দুঘন্টা সময়ও তারা দেবেনা পরিবার ও নিজেকে! নিজেরাও তো স্বনির্ভর হতে শিখছে। আরেকটা অকাট্য যুক্তি হলো যে বাড়ির কাজ করার চাপ না থাকলে এই দুঘন্টাও ওরা মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ করেই কাটাবে। ওদেশে রান্নার পদ্ধতি অনেক ছিমছাম – প্রধানত সিদ্ধকরা, ভাজা, ফোড়ন দেওয়া, আর স্যালাড। কাটাকুটি করতে হয়। রান্নাঘর আধুনিক। দুভাইবোনে যে যার নিজের কাজ দিব্যি করে।

কলিং বেল বাজিয়ে ঢুকলেন এরসিলিয়া, মার্সিয়ার প্রবীণা প্রতিবেশী, বান্ধবীও। স্বামী-স্ত্রী পাশেই থাকেন। মার্সিয়ার ঘরের জানলা দিয়ে ওঁদের ছিমছাম সুন্দর রং করা বাড়ির দোতলাটা দেখা যায়। এরসিলিয়ার সঙ্গে পথেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে, কথোপকথন হয়েছে। মার্সিয়া দোভাষী, উনি পর্তুগিজ, আমি এস্পেরান্তো। সঙ্গে বিশ্ববোধ্য হাসি-চুমু-আলিঙ্গন! এরসিলিয়া আমার জন্যে এমব্রয়ডারি করা ছোট্ট তোয়ালে আর রুমাল উপহার এনেছেন। আর এনেছেন ওঁর গাছের টাটকা কচি পুঁইশাক। আমিও ওঁকে একজোড়া সুতোর কাজ করা কানের দুল দিলাম। এ-সবের পরে ই-মেল দেখলাম। মার্সিয়া নানান দেশের গান শোনালো ইন্টারনেট থেকে। এবার মধ্যাহ্নভোজ। আজকের মেনুতে বিনস আর আলুসিদ্ধ, একটা তরকারি, একটু চাটনি মতো। পাশে রাখা আছে মশলা আর অলিভঅয়েল – স্বাদ মতো ছড়িয়ে নেবার জন্যে। শেষে একটু মিষ্টিমুখ। ঠিক হলো ঘন্টাখানেক পরে বেরোনো হবে।

মার্সিয়া, মারিয়ানা আর আমি ট্যাক্সি করে চলেছি রোজক্রুৎসিয়ানা চর্চার সেন্টারে। এটি এক ধরনের ধর্মীয় তাত্ত্বিকতা, এখানে যার চর্চা হয় মিশরীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে। ইংরিজিতে নাম Rosicrucian Order। অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো, সঙ্গে আলিঙ্গন-চুম্বন। দু-একজন একটু ইংরিজি জানেন। ওদের রীতি অনুসারে প্রার্থনা-মেডিটেশন-পাঠ-আলোচনা হলো। মার্সিয়ার খুব পছন্দের জায়গা এটি।  এখানের পর্ব শেষ করে একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে খানিক বাজার করা হলো। ইতিমধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তারই মধ্যে ছুটে-দৌড়ে-দাঁড়িয়ে-ভিজে-ট্যাক্সি ধরে বাড়ি। এখানেও রাস্তায় জল জমে দেখে চমৎকৃত হলাম! আরো একটা দিন কাটলো।

আবহাওয়া আজ বেড়ানোর মতো। রোদ নেই। মেঘ, তবে বৃষ্টিও নেই। সকালে মেট্রো চড়ে শহরের দক্ষিণ দিকে পাড়ি। গন্তব্য বিশ্ববিখ্যাত বিচ কোপাকাবানা। মেট্রো দিয়ে সারা শহর জোড়া। মাটির নিচে ও ওপরে দুই লেভেলেই মেট্রো চলে। তবে কোলকাতা মেট্রোর তুলনায় ব্যবস্থা বিপুলতর। সেই মেট্রোতে অফিসটাইমে চড়লে এ দেশের বহুমাত্রিক চেহারাটা স্পষ্ট হয়। নানান উচ্চতার, নানান বর্ণের, নানান আয়তনের, নানান চুলের, নানান মুখাবয়বের, নানান পোশাকের মানুষের মিছিল। ব্রাজিল হলো মেল্টিং পট। আয়তনে ভারতের প্রায় দ্বিগুণ, পৃথিবীতে পঞ্চম। কিন্তু জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক কম। সেই নিরিখেও পৃথিবীতে পঞ্চম। আমরা দ্বিতীয়। বহু বৈচিত্র্যের মধ্যেও 8,514,876 বর্গ কিলোমিটারের এই দেশে আসমুদ্র-হিমাচল একটি মাত্র সরকারি ভাষা দিয়েই কাজ চলে – পর্তুগিজ। প্রত্যেকে জানে ও বলে। পর্তুগিজ ছাড়াও 150টিরও বেশি জনজাতির ভাষা আছে, কিন্তু কোনোটিরই সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি নেই। ইংরিজি কলকে পায় না। এমনকি কম্প্যুটারেও অনুপস্থিত।

কোপাকাবানা বিচ বরাবর গাড়ির রাস্তার ফুটপাত সাদা-কালো ছোটো ছোটো চৌকো পাথর দিয়ে নকশা করে বাঁধানো – সাদা জমির ওপর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কালো পাথরের সমান্তরাল ঢেউয়ের নকশা সমুদ্রের সমান্তরালে লম্বা চলেছে। ফুটপাতে বিচের ওপরে কফিশপ, রেস্তোরাঁ, চেয়ার ভাড়া দেওয়া, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি আছে। সকাল বেলা, তায় অফিসটাইম। ভিড় নেই। রাস্তা পেরিয়ে শহরের দিকের ফুটপাতে বড় বড় সুদৃশ্য অভিজাত হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট। এটা শহরের দামী অভিজাত অঞ্চল। আজ রোদ নেই বলে বিচের বালি গরম নয়। অনেকক্ষণ বসে বসে ঢেউ দেখা হলো।। ঢেউয়ের সঙ্গে জাহাজ, পাহাড়, ঘর-বাড়ি, রাস্তা, মানুষজন সবই। বিচে সমুদ্রবিলাসীদের পরনে যৎসামান্য পোশাক। সব বয়সী মহিলারাও আছেন তার মধ্যে। যে-যার মতো পোশাকে। পোশাকের স্বল্পতা এতই স্বাভাবিক ব্যাপার যে এখানে পোশাক নিয়ে কারো চোখে কোনো কৌতূহল আর অবশিষ্ট নেই। সমুদ্রতট বা শহরের রাস্তা বা বিমানবন্দর বা রামকৃষ্ণ আশ্রম বা আর যেখানে যেখানে গেছি সর্বত্রই একই মনোভাব দেখেছি। শুধু আমার চোখেই অসীম কৌতূহল! আমি নিষেধাজ্ঞার দেশের মেয়ে। যেখানে সব নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যই মেয়েরা। সেই নিষেধাজ্ঞার ঠুলি পরানো চোখে চুপিচুপি ইতিউতি চাইছি। যাকে বলে মেয়ে দেখছি। আর মনে মনে এই ভেবে তারিফ করছি যে এরা মেয়ে-পোশাকের এমনই হদ্দমুদ্দো করে ছেড়েছে যে পোশাকের দিকে, আসলে মেয়ে-শরীরের দিকে, নজর দেওয়ার ব্যাপারে একটা গণতান্ত্রিক বৈরাগ্য অর্জন করে ফেলেছে। উপরন্তু পোশাককে যে কোনো অপরাধের হেতু হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় এই কষ্টকল্পনাটাও সকলের মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে! সমুদ্রে আজ কেউ স্নান করছে না। ঢেউ যথেষ্ট অশান্ত বলে বিচে জায়গায় জায়গায় নোটিস বসানো যাতে কেউ জলে না নামে। মাথার ওপর মাঝে মাঝেই হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। অনেকেই বিচে এসেছে হাতে ফুল নিয়ে। এক গোছা বা একটি গোলাপ। এখানকার রীতি হলো বছরের শেষে বা প্রথমে সমুদ্রের দেবীকে ফুল আর সুগন্ধি নিবেদন করে প্রার্থনা করা যাতে আগামী বছর ভালো কাটে। যারা ওই সময়ে সমুদ্রের ধারে আসতে পারে না তারা যখন আসে তখন সেই আচার পালন করে। তবে সমুদ্র তো কিছুই নেয় না। সব ফুলই ঢেউয়ে চড়ে ফিরে আসছে বালিতটে। মোটা মোটা চাকার ট্রাক্টরের মতো গাড়ি বিচে ঘুরে ঘুরে সেই সব ফুল ও আবর্জনা তুলে নিচ্ছে।

কোপাকাবানা থেকে বাড়ি ফেরা হলো বাসে, সমুদ্রের ধার দিয়ে রাস্তা। মেরিন ড্রাইভ। তারপর শহরের ভিতর। দুপুরের পাতে ফ্রেঞ্চব্রেড, লেট্যুস-টমেটোর স্যালাড, কিসের একটা বড়া, বেগুনভাজা আর অনেকটা আইসক্রিম।

ঠিক হয়েছে আজ সন্ধ্যেয় মার্সিয়া আমাকে নিয়ে যাবে ওর আরেকটা আধ্যাত্মিক গ্রুপে যেখানে ওর দায়িত্ব লাইব্রেরি দেখাশোনা করার। প্রথমে একটা শাটল গাড়িতে চড়ে একটা দোতলা কিন্তু বিশালাকার মলে গেলাম। বেশ খানিক ঘুরেফিরে, একটু কেনাকাটা করে যাওয়া হলো ওর সেই লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে কাজ করতে করতেই কথা হচ্ছিল। মার্সিয়া ছবি বা বই সাজানোর ব্যাপারে একটা দারুণ কথা বলল – বলল যে মান্দারিনভাষীরা সাজায় ওপর থেকে নিচে, আমরা বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আর আরবিভাষীরা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। ফেরার পথে আজও বৃষ্টি, ফলে আজও ভেজা। রাতের পাতে ছিল ভাত, অবশ্যই অন্যরকম, বিনস, মশলা ও অলিভঅয়েল ছড়ানো রাঙাআলু সিদ্ধ আর আইসক্রিম। সকালে মারিয়ানা রান্নায় বেশি নুন দিয়ে ফেলেছিল বলে রাতে মার্সিয়া খাবারে নুন দিতেই বারণ করেছিল। যে যার মতো নুন ছড়িয়ে খাওয়া হলো।

দেখতে দেখতে আজ তিন তারিখ। আজ জেসাস দ্য রিডিমার স্থাপত্য দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। কিন্তু অবহাওয়া দেখে মার্সিয়া বলল আকাশে মেঘ থাকলে ওখানে গিয়ে লাভ নেই কারণ ওপর থেকে শুধুই মেঘ দেখা যায়, শহরের কিছুই দেখা যায় না। আরো তো দুদিন হাতে আছে। অপেক্ষা করা যাক। তারপর ইন্টারনেট দেখে বলল যে পরের দুদিনে অবহাওয়া আরো খারাপ হবে, বৃষ্টিও হবে। শেষে সাব্যস্ত হলো যে কপাল ঠুকে আজই যাওয়া হবে। মার্সিয়াও আগে কখনো যায়নি ওখানে। ইন্টারনেট থেকে বাস, সময়, টিকিট, ট্রেন সব কিছুর খবর সংগ্রহ করে বেরোনো হলো। শহরের প্রায় অন্যপ্রান্তে ট্যুরিস্ট সেন্টার, ছোট্ট রেল স্টেশন। সেখান থেকে দু-কামরার ছোটো ছোটো ট্রেনে করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাইশ মিনিট দূরত্ব অতিক্রম করে পাহাড়ের চুড়োয় জেসাস দ্য রিডিমারের মূর্তির পাদদেশে পৌঁছোনো। পাহাড় ঘুরে ঘুরে বাস ও গাড়ির রাস্তাও আছে। বাসে গেলে একটু সস্তাও হয়। আমরা ট্রেনেই গেলাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খাড়া উঁচুতে ওঠা। হাজারো গাছের মধ্যে বিশাল লম্বা লম্বা কাঁঠালগাছ আপাদমস্তক কাঁঠাল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে। খাবার কেউ নেই। ফল মাটিতে পড়ে গড়াচ্ছে, পচছে। মাঝে মাঝে গাছের ফাঁক দিয়ে নিচের সমুদ্র ও শহর দেখা যাচ্ছে। ট্রেনেযাত্রার শেষে চূড়োয় ওঠার লিফ্টও আছে, সিঁড়িও আছে। আমরা সিঁড়ি নিলাম। চওড়া সিঁড়ি। কত লোক, কত লোক! গায়ে গায়ে ঠেকে যাচ্ছে। রেলিং থেকে দেখা যাচ্ছে নিচের সমুদ্র-ঘেরা সাজানো শহর। সমুদ্রের বুকেও ছোটো ছোটো পাহাড়। আজ ঝকঝকে রোদ। তাই নিচেটা ছবির মতো দেখাচ্ছে। এই ট্যুরিস্ট স্পটের আকর্ষণ দুটো – স্থাপত্য আর ওপর থেকে নিচের শহর দেখা। একেবারে ওপরের চাতালে যিশুর বিশাল মূর্তি দু-হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে। পিছনে, মূর্তির নিচে ছোট্টো একটি প্রার্থনাঘর। মূর্তির সামনে চওড়া রেলিং ঘেরা বিশাল চাতাল। সেখানে শয়ে শয়ে লোক চিৎ হয়ে শুয়ে মূর্তির ছবি তুলছে। কত কিসিমের ক্যামেরা! কত রকম ঠ্যাং লাগানো। সেলফির জন্যে স্টিকে লাগানো মোবাইল বা ক্যামেরা। সব ছেয়ে পছন্দের পোজ হলো যিশুকে পিছনে রেখে যিশুর মতোই দুহাত ছড়িয়ে সেলফি। নামার সময়ে লিফ্ট নেওয়া হলো। প্রথম দুটো তল এসক্যালেটর, তারপর লিফ্টের লাইন। তারপর যথারীতি ট্রেন, বাস, বাড়ি।

আজকের আরেকটা অভিজ্ঞতা হলো এখানকার রিজার্ভ ব্যাংক। রাস্তার ওপর একটা প্রাসাদোপম বাড়ি। গ্রানাইটের অত্যুচ্চ ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে বিশাল গোল উঠোন ঘিরে সাততলা প্রাসাদের বিস্তার। এক দিকের দেওয়াল ধরে মার্বেলের চওড়া সাদা সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে। অন্য পাশে পুরোনো স্টাইলের অভিজাত লিফ্ট। বাড়ির সব ফিটিংস, বাতিঝাড়, সিড়ির রেলিং, মায় লিফ্টের কোলাপসিবল দরজাও পেতলের, সোনার মতো ঝকঝক করছে। এটা দেশের রিজার্ভ ব্যাংকের মিউজিয়াম। ওপরের তলার বিশাল বিশাল ঘরের দেওয়াল জোড়া কাঁচের শোকেসে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রকমের কাগজের নোট সাজানো। ঘরের মেঝেটা কাচের, কিছুটা ডিজাইন করা স্বচ্ছ, বাকিটা কালো। স্বচ্ছ অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাঁচের নিচে কংক্রিটের মেঝের ওপর ছড়ানো অজস্র কয়েন, পয়সা। নিচের মেঝে অবশ্য একটুও দেখা যাচ্ছে না, পয়সায় ঢাকা। একটা ঘরে প্রাচীন যুগের নানান ধরনের বিনিময় ব্যবস্থার ইতিহাস – ছবি ও মডেলে। অন্য একটি ঘরে নানান ধরনের দাঁড়িপাল্লা – প্রাচীন থেকে আধুনিক অবধি। রিজার্ভ ব্যাংকের সোনা ওজন করার পাল্লাটাও আছে। ওপর তলা ঘুরে নিচে এলাম। এই প্রাসাদে ছোটো ছোটো কটা প্রেক্ষাগৃহও আছে। আপাতত একটা হলে একজন বিখ্যাত নাট্যকারের ওপর প্রদর্শনী চলছে। ব্যাংকের কাজকর্মের সঙ্গে এসব মেলাতে না পেরে প্রশ্নের উত্তরে জানতে পারলাম যে এখানকার রিজার্ভব্যাংক বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করে যার মধ্যে অন্যতম হলো নাটক স্পনসর করা - দেশবিদেশের নাট্যদলের নাটক মঞ্চায়নের আয়োজন ও ব্যয়বহন। তাই এ প্রাসাদের দুটি তল জোড়া নাটকের প্রদর্শনী ও খবর!

কেটেছে আরো একটা দিন। আজ সকালে কোথাও বেরোনো নেই। মার্সিয়া ও আমি দুজনেই ক্লান্ত। তাছাড়া মার্সিয়ার কিছু পড়াশুনোর কাজও আছে। এদেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সর্বস্তরেই বয়স্কশিক্ষার পুরো দস্তুর বন্দোবস্ত আছে। সেই ব্যবস্থাতেই মার্সিয়া এখন বিভিন্ন ভাষা শেখে। এখন শিখছে ইটালিয়ান। তাছাড়াও বাইরে শেখে মান্দারিন আর স্প্যানিশ। নিজে নিজে বাংলা শিখতে চেষ্টা করে। ওর ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন ভাষা শেখার। কিন্তু বাড়ির অমত থাকায় ভাষা আর ডাক্তারির মধ্যে দ্বিতীয়টাকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। চার বছর পর অবশ্য কিছু অসুবিধের কারণে ডাক্তারি ছেড়ে আইন পড়ে। তারপর পুলিশের চাকরি। ওর দায়িত্ব ছিল মর্গে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত আর জীবিত আহতদের পরীক্ষা করা। এ কাজে ডাক্তারি আর আইনি – দুরকম জ্ঞানই জরুরি। এই কাজ স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক বলে অবসর মাত্র 45 বছর বয়সে। গত বছর ও অবসর নিয়ে ভাষা শেখার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ব্রতী হয়েছে। মার্সিয়া গাইতে, বাজাতে, আঁকতে পারে। দেশবিদেশের গান শোনে। দুই ছেলেমেয়ের গলাতেও সুর। দুজনেই হালকা মেজাজে থাকলেই সুন্দর শিস দেয়। ঠিক হয়েছে আজ সন্ধ্যেতে মারিয়ানা আার আমি একটা অভিযানে যাবো। এই পাড়াতেই জাপানি রেস্তোরাঁয় কাঁচা মাছ খেতে যাবো। সাধটা মারিয়ানার। ইন্ধন আমার কারণ আমি মাছ খাই। মারিয়ানার অকাট্য যুক্তি হলো – নিরামিশাষী মার্সিয়া কখনোই এই অভিযানে ওকে সঙ্গ দেবে না। মীনার সঙ্গে গেলে মার্সিয়া না বলতে পারবে না। আর মীনার জীবনে এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। সুতরাং মীনা যাবেই! অতএব যাবার অনুমতিও মিলল সহজেই। মারিয়ানা তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেট ঘেঁটে খাবারের পদের নাম, বর্ণনা, দাম সব জোগাড় করে নিটোল নিখুঁত হোমওয়ার্ক করে নিল।

অভিযান সফল। এই রাস্তাতেই গোটাদশেক বাড়ির পরেই জাপানি রেস্তোরাঁ। ভিতরটা লাল রঙের ডেকরেশন। লোকজনও আসছে, বসছে, খাচ্ছে। মারিয়ানা পকেট থেকে কাগজ বের করে দেখে দেখে অর্ডার দিচ্ছে। আমাদের প্রথম পদ মাশরুমের। ছোট্টো চারকোনা পোর্সিলিনের ট্রে, তাতে সাদা-কালো তিন ঢালো, ইচ্ছেমতো সোয়াসস। এবার বাটি বা ট্রে থেকে হাশিতে (চপস্টিক) করে খাবারের টুকরো তুলে সেই তিলে মাখাও আর মুখে পোরো। মারিয়ানাই ঠিক দিকে ঠিকমতো হাশি ধরতে শিখিয়ে দিল। প্রথমে একটু যুদ্ধ করতে হলেও পরে আমি হাশি নিয়ে ধাতস্থ হলাম। এর পরের পদ কাঁচা মাছ - সাশিমি, নিগিরি, তেকা মাকি ও মাকি-মোনো। বড় একটা প্লেটে আঠেরো-কুড়ি টুকরো সাজানো, সঙ্গে লেট্যুস আর কি একটা পাতা, হালকা ঝালের লংকাবাটা, সসে ভেজানো আদার টুকরো, সরু সরু করে কাটা মুলো। মাছের মধ্যে একটাই চেনা – চিংড়ি। স্বাদ বেশ মুখরোচক। কাঁচা বললেও আদতে কাঁচা বলতে আমরা যা বুঝি তা নয়। নানান ধরনের সস দিয়ে প্রসেস করা, তবে আগুন বা উত্তাপের সংস্পর্শহীন। মারিয়ানার সৌজন্যে ব্রাজিলে বসে জাপানি খানা চাখবার সৌভাগ্য হলো। অভিযানের আগে আরো একটা বড় কাজ হয়েছে। বড় স্যুটকেস আর বইগুলো টেনে নিয়ে গিয়ে বড় রাস্তার ওষুধের দোকানের ওজন-মেশিনে ওজন করা। বেরনার্দো ফোন করে জেনে নিল দোকান খোলা আছে কিনা। তারপর আমি আর মারিয়ানা সব নিয়ে গিয়ে ওজন করলাম। পয়সা লাগে না ওজন করতে। ওজন সীমার মধ্যেই আছে ও থাকবে জেনে নিশ্চিন্দির ঘুম!

অদ্যই শেষ রজনী নয়, শেষ দিবস। সকাল থেকে বেশ খানিক ঘোরা হলো, কোথাও দেখার জন্যে কোথাও বা কাজের জন্যে। সামান্য বৃষ্টিও রয়েছে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে বার্ক বা ছোটো জাহাজে চড়ে সমুদ্রের বুকে দ্বীপে যাওয়া হবে। হলো না। কারণ আমরা ভুল করে কোপাকাবানার বাসে উঠে পড়েছিলাম। ভালোই হলো। আবার সেই সমুদ্র, ঢেউ, আকাশ, বিচ, স্নানবিলাসীর দল, পাহাড়, শহর আর বিচের গুমটি কফিশপে কফিপান। এবার মেট্রো চড়ে ৎসেনত্রো উর্বো, নগরকেন্দ্র। প্রথমে ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সেখানে বই ফেরৎ দেওয়া। এ লাইব্রেরিতে যত পাহারা তত সাজানো। আমি বাইরে অপেক্ষা করলাম। মার্সিয়া কাজ সারলো। এবার টুকিটাকি কেনার জন্যে বাজার, আমাদের বড়বাজারের মতো বাজার। একটা চত্বর, ভিতরে বাস বা গাড়ি ঢোকে না। অসংখ্য অলিগলি। অগুন্তি দোকান ও ফেরিওয়ালা, রাস্তা ও ফুটপাত জুড়ে। কী নেই! সামনে কার্নিভাল আসছে। বিকিকিনি তাই তুঙ্গে। ইন্টারনেটে দেখেছি ব্রাজিলের অনেক শহরেই অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি। রিওতেও। কিন্তু এই ভীড় বাজারেও মার্সিয়া আমাকে পিঠের ব্যাগ নিয়ে সতর্ক করলো না, বা আমারও কোনো অস্বস্তি বোধ হলো না। তাই ভাবলাম হয়তো শহরের কোনো অঞ্চলে ক্রাইম রেট খুব বেশি। কিন্তু তার জন্যে পুরো শহরকেই অপরাধী বলে দেগে দেওয়া যায় না। এবার ব্যাংক। ব্যাংকে ঢোকার দরজা গোল গম্বুজ, তার ভিতরে চারপাল্লার স্যুইংডোর। নম্বরটিপে ঘুরিয়ে ঢুকতে হয়। আমি ঢুকলাম বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে। দরজা পেরিয়েই দেওয়ালে, একটু উঁচুতে, ছোট্টো ঘেরা অর্ধবৃত্তে একজন নিরাপত্তারক্ষী, শ্যেন দৃষ্টিতে বন্দুক নিশানা করে প্রস্তুত, ঠিক যেমন বিমানবন্দরের বাইরে বস্তা আর জালের আড়ালে মিলিটারিরা থাকে আমাদের দেশে। আবার বাস। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাসে দু’রকম সিস্টেম। পয়সা দিয়ে দরজা গলে ঢোকা আর কার্ড পাঞ্চ করে দরজা গলে ঢোকা। বাসে ড্রাইভারের পাশে সামনের দরজায় দু ধাপ বেয়ে উঠে ভিতরে ঢোকার রেলিং-এর ঘোরানো দরজা। পয়সা দিলে বা কার্ড পাঞ্চ হলে তবেই সে দরজা এক ঘাট ঘুরবে, একজনকে ভিতরে যেতে দেবে। দরজা বেশ শক্তপোক্ত। জোরে ঠেলে ঢুকতে হয়। ঢুকতে দেরি করলে ডবল টিকিটের দাম গুনতে হয়। কোনো বাসে চালকই টিকিটের পয়সা সংগ্রহ করে ও দরজা নিয়ন্ত্রণ করে। আবার কোনো বাসে এ-কাজের জন্যে আলাদা একজন পুরুষ বা মহিলা থাকে। কোনো কোনো বাস এসি হলেও ভাড়া একই। মার্সিয়াকে জিগেস করে জানতে পারলাম যে সদ্য আইন পাস হয়েছে যে সব বাসই এসি করতে হবে। তাই বাস এসি করার পর্ব শুরু হয়েছে, শেষ হতে একটু সময় লাগবে। মার্সিয়া কেন বাসে প্রতিবারই পয়সা দেয়, কার্ড ব্যবহার করে না তা জিগেস করে জানলাম যে কার্ড মানে অন্য কেউ তোমার হয়ে পয়সাটা দিচ্ছে। যেমন সিনিয়র সিটিজেন আর মাঝের লেভেল পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা যে কার্ড ব্যবহার করে তার জন্যে রাষ্ট্র পয়সা দেয়। এটা সরকারি ব্যাবস্থা। তাছাড়া অনেক অফিসই নিজের কর্মচারীদের রাহাখরচ বহন করে, কর্মচারীদের কার্ড করে দেয়। নিজের কার্ড নিজে কেনার কোনো ব্যবস্থা নেই। কার্ড ব্যবহারকারী বিনা পয়সায় বাসে চড়ে।

আজ শেষ মধ্যাহ্নভোজের পাতে সিরিয়াল মেশানো ভাত, কালো বিনস, বেগুনভাজা, গাজরের স্যালাড আর শেষে কুমড়ো ও নারকেলের মিষ্টি। সব গোছগাছ সেরে পৌনে পাঁচটা নাগাদ দুটো স্যুটকেস টেনে টেনে বড় রাস্তায় পৌঁছে ট্যাক্সিতে চড়া হলো। প্রথম গন্তব্য সেই মিশরীয় আধ্যত্মিকতা রোজক্রুৎসিয়ানোর গৃহ। সেখানে সবাই আমাকে নিয়ে ছবি তুলতে চায়। সেখানে পৌঁছে ট্যাক্সিচালকের মুখে শোনা গেল যে আজ শহরে প্রোটেস্টান্টদের বা অন্য কারুদের প্রতিবাদ দিবস, ফলে ট্রাফিকের হাল খারাপ হবে। শুনে মার্সিয়া অত অবধি ভাড়া মিটিয়ে ওঁকেই এয়ারপোর্ট যাবার জন্যে অপেক্ষা করতে বলে, ব্যাগপত্র রেখেই আমাকে নিয়ে নামল। মার্সিয়া প্রথমেই বলল যে বিদায়পর্বে ওর বিমানবন্দরে যেতে ভালো লাগে না, তাই ও আমার সঙ্গে যাবে না। ঠিক আছে। রোজক্রুৎসিয়ানোর বাড়িতে ঢুকলাম। ছবি তোলা, চুম্বন-আলিঙ্গন ও বাই-বাই করার পর্ব শেষ হতে  আবার ট্যাক্সিতে ওঠা। মার্সিয়া আমার হাতে পঞ্চাশ রিয়ালের নোট গুঁজে দিতে চাইলেও আমি নিলাম না। বললাম তিরিশের বেশি রিয়াল আছে আমার কাছে। আর লাগবে না।

বয়স্ক ট্যাক্সিচালক। ছিটেফোঁটা ইংরিজিও বোঝেন না। রিওতে দুটি বিমানবন্দর – আন্তর্জাতিক ও অন্তর্দেশীয়। মার্সিয়া সম্ভবত কোনটিতে যেতে হবে তা বলে দেয় নি। আমার গন্তব্য অন্তর্দেশীয়টি। চালক অবশ্য ইতিমধ্যেই মার্সিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতে জেনে গেছেন যে আমি ভারতীয় এবং দেশে ফেরার উড়ান ধরতে চলেছি। অতএব উনি নিয়ে যেতেই পারেন আন্তর্জাতিকে। অত ভাবনা-চিন্তার সময় নয় এখন। আজই তো নিজের পায়ে দাঁড়াবার দিন! টিকিটটা দেখালাম চালককে। ওঁর হাবভাবে মনে হলো যে বুঝেছেন কোন বিমানবন্দর। তবু সন্দেহ যায় না। ঠিক বুঝেছেন তো? এবার যাত্রা শুরু। রাস্তায় কী প্রচণ্ড জ্যাম। খুব টেনশন হচ্ছে। সময়ের জন্যে নয়। হাতে অঢেল সময় আছে। কিন্তু মিটার উঠছে। আর আমার কাছে সর্বসাকুল্যে তিরিশ কী বত্রিশ রিয়াল। একবার হাতের মুদ্রায় ওঁকে জিগেস করলাম এখনও অনেকটা রাস্তা না একটুখানি? উনি দেখালেন কাছেই। জ্যাম জ্যাম। আশাপাশে শুধুই দুর্ভেদ্য জ্যাম! নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছি! তারপর একসময় ভিড় পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সাঁই সাঁই করে এসে থামলাম বিমানবন্দরের দরজায়। একটা সাদা কাগজে যোগ বিয়োগ করে চালক দেখালেন যে আমাকে পঁচিশ রিয়াল দিতে হবে। তিরিশ দিয়ে পাঁচ ফেরৎ পেলাম। নেমে ট্রলি নিয়ে আসতে উনি স্যুটকেস দুটো নিজে তুলে দিলেন তাতে। তারপর হ্যান্ডশেক – ওব্রিগাদা – ধন্যবাদ! আন্তরিকতার কোনো ভাষা হয় না!

ভরা ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকে জিগেস করে জানলাম যে উড়ানের দু’ঘন্টা আগে ব্যাগেজ দিতে হবে। উড়ান রাত দশটা তেরোতে। এখন ছটা পনেরো। বোর্ডের জ্ঞাপনেও উড়ান দেখাচ্ছে না। অতএব অপেক্ষা। এই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি যোগাযোগবিহীন। মার্সিয়ার মোবাইল ফেরৎ দিয়ে এসেছি। আমার মোবাইল অকেজো। 

ফিরতি পথে প্রথমে যাবো সাঁও পাওলো, ডোমেস্টিক এয়ারলাইন গোল-এ। সেখান থেকে এমিরেটস-এ দুবাই, তারপর কোলকাতা। মার্সিয়া বলেছিল সম্ভবত সাঁও পাওলোতে ব্যাগেজ সংগ্রহ করে আবার চেক-ইন করতে হবে। কারণ দুটো আলাদা এয়ারলাইন্স তো। সাঁও পাওলোতে হাতে সময় মাত্র দু’ঘন্টা। অন্তর্দেশীয় থেকে আন্তর্জাতিক অংশে যেতে হবে। একটুও সময় যেন নষ্ট না করি। আটটার পরেও কোনো চেক-ইন ঘোষণা হলো না দেখে লটবহর নিয়ে নিজেই এগিয়ে গেলাম কাউন্টারে। খোঁজ নিতে চেক-ইন করতে বলল। বাইরের মেশিন থেকে বোর্ডিং পাস নিতে হলো না, কাউন্টার থেকেই দিল। তবে সবচেয়ে নিশ্চিন্তির খবর হলো যে ব্যাগেজ কোলকাতা অবধিই বুক হলো। মানে সাঁও পাওলোতে আমাকে আবার চেক-ইন করে বোর্ডিং পাস নিতে হবে বটে, কিন্তু ব্যাগেজের ভাবনা করতে হবে না, ওটা সোজা কোলকাতা চলে যাবে। কাউন্টারের কর্মীরা টিকিটে DXB লেখাটার মানে বুঝতে পারছে না। বললাম যে ওটা দুবাইয়ের কোড। ওদের কৌতূহল মিটল, খুশি হলো। দোতলায় উঠে অপেক্ষায় আছি। বোর্ডিং টাইম নটা তেত্রিশ। গেট এখনও  খোলেনি।

দেখা ও শোনা

ব্রাজিল দেখে আসার পর বছর গড়িয়ে গেছে। এখন যোগাযোগ বলতে মার্সিয়া আর খবরের কাগজ। ব্রাজিলের অর্থনীতিতে ফাটল ধরেছে। ভেঙে পড়ার মুখে। বিপর্যয়ের হেতু হিসেবে আঙুল উঠেছে রাজনীতির দিকে -  রাজনীতিকদের লাগামছাড়া লোভ ও দুর্নীতিপরায়ণতা। সাধারণ নাগরিককে ঠকিয়ে দলের নামে নিজের স্বার্থে দেশের সম্পদের অপব্যবহার। অপরাধীর কাঠগড়ায় ব্রাজিলের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। ওয়ার্কার্স পার্টির দিলমা রুসেফের অতীতের পরিচিতি মার্কসিস্ট গেরিলা হিসেবে। তাঁর বামপন্থী পার্টি ও তিনি এক সময়ে ব্রাজিলে মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। আপাতত 17 এপ্রিল, 2016, ব্রাজিলের পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের ভোটে প্রেসিডেন্ট অভিযুক্ত সাব্যস্ত হওয়ায় লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতিতে তেরবছরের বামপন্থী গণতন্ত্রের অস্তিত্বই প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝুলে রয়েছে। অভিযোগ যে প্রেসিডেন্ট পরবর্তী নির্বাচনে নিজের জয় নিশ্চিত করার জন্যে বাজেটে ব্যাপক কারচুপি করেছেন, বেআইনিভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিংব্যবস্থার অপব্যবহার করেছেন। যার ফলে দেশের অর্থনীতি এখন ধুঁকছে। এই হেতুই ইমপিচমেন্ট। এর পরবর্তী পর্বে তাঁর বিচার সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্ত নেবে ব্রাজিলের সেনেট। তবে দেশের জনগণ একদিকে যেমন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে অসন্তুষ্ট, অন্যদিকে আবার তাঁর এই ইমপিচমেন্ট নিয়েও তেমন সন্তুষ্ট নয়। ষাট শতাংশেরও বেশি নাগরিক এই ইমপিচমেন্ট সমর্থন করে। আবার পাশাপাশিই জনগণের মতে, যাদের ভোটে প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট হলো তারাও কিছু কম দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, বরং আরো বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে দুর্নীতি ঢুকেছে রাজনীতিকদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র-রাজনীতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁচাবার জন্যে প্রতিবাদ জানাচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দু-দশকের মিলিটারি শাসনের পর 1985-এ ব্রাজিল আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে এই বিপুল বিপর্যয়! ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, শাসন বা বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। কিন্তু রাজনীতিকদের অনন্ত দুর্নীতি ও অসীম গা-জোয়ারি আমাদের চারপাশের বাস্তবের এক অতি পরিচিত ছবি। আর নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার তথা গণতন্ত্রকে বাঁচাবার জন্যে প্রয়োজনীয় লড়াই-প্রতিবাদের ভাষা তো আমার-আপনার মতো সাধারণ নাগরিকের মনেও জমা রয়েছে। এই ক্ষোভ-রাগ-প্রতিবাদ-ব্যর্থতা-ভয়-খুন হয়ে যাওয়া তো ক্রমশ আধুনিক নাগরিকত্বের গ্লোবাল ফিচার হয়ে উঠছে!

মার্সিয়ার মুখে শোনা ভেঙে-পড়া-অর্থনীতির এক টুকরো ছবি দিয়ে শেষ করি। আগেই বলেছি যে অবসরের পরে মার্সিয়া এখন প্রাণভরে অনেকগুলো ভাষা শেখে – কোনোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোনোটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ওর দৈনন্দিন যাপনের অনেকটা জুড়েই এখন রিও দি জানেইরো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট চলছে অনির্দিষ্ট কাল ধরে। লেখাপড়া-গবেষণা সব শিকেয় উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে নিচুস্তরের কর্মীরা, বিশেষত সাফাইকর্মীরা, ধর্মঘট করেছেন দীর্ঘদিন মাইনে না পাবার কারণে। কোনো কর্মী বা অধ্যাপকই ঠিক সময়ে বেতন পান না, বকেয়াও প্রচুর। তার ওপর ক্রমশ জমে ওঠা জঞ্জালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দূষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ-লেখাপড়া-গবেষণা চালাবার মতো কোনো পরিস্থিতিই নেই। যে অধ্যপকেরা অবসর নিচ্ছেন তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধে থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র অসন্তোষ আর হাহুতাশ! রাষ্ট্র নির্বিকার! মার্সিয়া ও মার্সিয়ার মতোই সাতে-পাঁচে-না-থাকা সাধারণ সভ্য দায়িত্বশীল বাধ্য নাগরিক বড় কষ্টে আছে। এই কষ্টের শেষ হোক। ব্রাজিল ঘুরে দাঁড়াক। দুর্নীতির মোকাবিলা করুক, তার অর্থনীতি চাঙ্গা হোক। আর তাই দেখে বাকি বিশ্বের নাগরিক আবার বুকে বল-ভরসা নিয়ে বাঁচুক! 

----------